আহা কী দেখিলাম
‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’ কানে এল এক সুমিষ্ট নারী কণ্ঠস্বর। আদিগন্তবিস্তৃত সুনীল সাগরের ঝাউ শোভিত বালুকাবেলায় বসে অনেকক্ষণ, বেশ অনেকক্ষণ ধরেই আনমনে তাকিয়ে ছিলাম সেই নীলাম্বুর দিকে। তখন গোধূলির বয়স কিঞ্চিৎ বেড়েছে বটে, কিন্তু আঁধার তখনো জাঁকিয়ে বসার সুযোগ পায়নি। অস্তাচলগামী অর্চিষ্মানের শেষ আভায় ঊর্মিমালীর হাজারো ঊর্মিমালার ফণাতেই তখন শুধু দেখছি শ্বেতদ্যুতির ছটা, হিরণ্যদ-এর বাকি অংশের দীপ্তি কিন্তু বেশ ম্লান। সৌন্দর্যসুধা আস্বাদনে আচমকাই যেন ছেদ পড়লো বামাকন্ঠের সেই প্রশ্নে। চমকিত হয়ে চারিধারে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলাম। কেউ কোথাও তো নেই? গোটা চরাচর জনপ্রাণীশূন্য। শুধু দমকা হাওয়ায় আন্দোলিত হচ্ছে ঝাউগাছের দল।
ভাবছি এ কি ভুল শুনলাম? হতেও পারে। স্থানমাহাত্ম্যের একটা প্রভাব তো থাকেই অনেকসময়।
আর স্থানমাহাত্ম্য তো বটেই, বসে আছি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ সেই দরিয়াপুর সমুদ্রসৈকতে, যেখানে কিনা কয়েকশো বছর আগে গঙ্গাসাগর দর্শনান্তে ফেরার সময় নবকুমারের দিকভ্রষ্ট নৌকা ভিড়েছিল।
তারপরেই তো ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের বর্ণনা অনুযায়ী এই জায়গাতেই প্রথমে কাপালিক, পরে কপালকুন্ডলার সাথে সাক্ষাৎ ঘটেছিল। নবকুমারের উদ্দেশ্যে ভেসে এসেছিল কপালকুন্ডলার সেই মধুর প্রশ্ন, যেটা আমি যেন শুনতে পেলাম এইমাত্র ! আসলে বাঁকিপুট-দরিয়াপুরের এই অঞ্চলে এসে, নির্জন সমুদ্রসৈকতে বসে, নবকুমার-কপালকুণ্ডলা এইসবই ভাবছিলাম বোধহয় অনেকক্ষণ ধরে। অবচেতন মনের সেই ভাবনাই বোধহয় রূপ পেল এইভাবে? কিংবা অন্যটাও তো হতে পারে? যুগ যুগ ধরে, এই ঘন ঝাউবনের অন্দরে অন্তরে, পাতার শিহরণে, ক্রমাগত অনুরণিত হয়ে চলেছে নবকুমার, কপালকুন্ডলার কথোপকথনের সেই ঐতিহাসিক সংলাপ? হবেও বা।
কর্মসূত্রে বঙ্কিমচন্দ্র দরিয়াপুরে ছিলেন বেশ কিছু সময়। আর এই অবস্থানকালেই তাঁর লেখনীতে সৃষ্ট হয় বিখ্যাত সেই উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’। গল্পে বর্ণিত কাপালিকের মন্দিরটি বর্তমানে পরিচিত ‘কপালকুণ্ডলা মন্দির’ নামে। আদ্যন্ত সংস্কারের পর প্রাচীন মন্দিরটি এখন নব্যকান্তিতেই প্রতিভাত। অবশ্য তার পাশেই অবস্থিত শিব মন্দিরটি ও প্রাঙ্গনের বিশাল বটগাছটির প্রাচীনত্ব অবশ্য সহজেই বোঝা যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের একটি আবক্ষ মূর্তিও রয়েছে সেখানে।
এবারে একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাই। এখানে এই পথিক, মানে আমি কিন্তু মোটেই পথ হারিয়ে ওই অঞ্চলে পৌঁছোইনি। দিব্যি পথ চিনেই, খাস একটা উইকেন্ড কাটাবো বলে, পাড়ি দিয়েছি বাঁকিপুট। জায়গাটির নাম কিন্তু বাঁকিপুর নয়, বাঁকিপুট। পোর্টের ( সমুদ্রবন্দর ) অপভ্রংশ থেকে এসেছে এই পুট শব্দটি, যেমন জুনপুট। তা, সকাল সকাল কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে মাত্র সাড়ে তিন ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বাঁকিপুটে। দিঘাগামী রাস্তা ধরে নন্দকুমার মোড়, কাঁথি, জুনপুট হয়ে পৌঁছে গেলাম বাঁকিপুটে।
নিরালা নির্জন বাঁকিপুট মুগ্ধ করল প্রথম দর্শনেই। কম ভালো না লাগলোনা থাকার জায়গাটিকেও। ঝিনুক রেসিডেন্সি। সমুদ্রের ধারে দু বিঘা জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে এই সুন্দর আবাস। পুকুর ( অবশ্যই মৎস্যপুষ্ট), বাগান, ছোট্ট এক নজরমিনার ইত্যাদি নিয়ে গঠিত ঝিনুক রেসিডেন্সির পরিসরটি বেশ মুগ্ধ করলো। একদম গা ঘেঁষেই নিবিড়, মনকাড়া এক ঝাউবনের অবস্থান। ঝাউয়ের ছায়ায় ছায়ায় মাত্র কয়েক কদম গেলেই দেখা মিলবে সেই দিগন্তবিস্তৃত সুনীল সাগরের। পুকুরের সুস্বাদু মাছ দিয়ে গুছিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে, হাল্কা ন্যাপ নিয়ে, সেই যে গিয়ে বসলাম ওই চূড়ান্ত নির্জন, জনমনিষ্যিবর্জিত, রোমান্টিক সৈকতে; একেবারে সম্বিৎ ফিরলো সেই কুহকিনী মায়ায়- ‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’
পরদিন সকালে প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম কাছাকাছি দর্শনীয় স্থানগুলি দেখতে। কিছুদূরেই ব্রিটিশ আমলের এক লাইটহাউস গর্বভরে আকাশপানে ঘাড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে তাতে ওপরে ওঠাই বড় দায়। সে দায় নাহয় তবু সামলাতে পারলাম, কিন্তু চারপাশের অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার দায় আর সামলানো গেলোনা। লাইটহাউসের পাশেই সমুদ্র। অপ্রশস্ত পাড়ে রয়েছে বেশ কিছু বসার জায়গাও। দেখছি ঢেউয়ের পর ঢেউ উঠছে নামছে অক্লান্ত নিয়মানুবর্তিতায়। সমুদ্রপাড় অনেকটাই বাঁক নিয়েছে, প্রায় অর্ধচন্দ্রের মত। এই বঙ্কিম তটরেখা থেকেই মনে হয় জায়গাটার নাম বাঁকিপুট।
এরপরেই সেই ‘কপালকুণ্ডলা মন্দির’ দেখে পৌঁছলাম দরিয়াপুর লাইটহাউস, বাঁকিপুট থেকে যার দূরত্ব মাত্র আট কিলোমিটার। এই লাইটহাউসটি খুব প্রাচীন নয় এবং এর ওপরে ওঠাও গেল ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে। উপর থেকে আদিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র, সমুদ্রতীরের নিবিড় বনানী ও গোটা অঞ্চলের যে ছবিটা এককথায় দেখতে পেলাম, তা অনবদ্য। লাইটহাউসের শীর্ষে ঘূর্ণায়মান বাতিঘরটিও দেখবার মত।
দরিয়াপুর লাইটহাউসের অনতিদূরেই বয়ে যাচ্ছে রসুলপুর নদী। এই নদীর কথাও উল্লিখিত আছে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে। পেটুয়াঘাটে এই জায়গাটা দেশপ্রাণ ফিশিং হারবার নামেই বেশি পরিচিত। জেটির পাশে দাঁড়িয়ে যেমন সুরম্য বিস্তার চোখে পড়লো, তেমনি চোখে পড়লো অগণিত মানুষের নদী পারাপারের দৃশ্যও। ঠিক ওপারেই খেজুরি।
হোটেলে ফিরে মধ্যাহ্নভোজটি তৃপ্তি সহকারে সেরে আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এবার যাবো অন্যপ্রান্তে, অচেনা কিছু সমুদ্রসৈকতে। জুনপুট (৩ কিমি), হরিপুর (৬ কিমি), শৌলা (৮ কিমি)- এগুলোর কোনোটাই বাঁকিপুট থেকে খুব দূরে নয়। ঝাউবন ঘেরা নির্জন সৈকতগুলিতে অপার আনন্দ তো আছেই, সঙ্গে আছে হাজার হাজার লাল কাঁকড়ার লুকোচুরি খেলার দুর্লভ দৃশ্যও। যেহেতু এইসব সৈকতে পর্যটকের পদচারণা বিরল,স্থানীয় মানুষজনের ভিড়ও নেই কিছুমাত্র, তাই কাঁকড়াগোষ্ঠীর হয়েছে মহা সুবিধা। এদিক ওদিক খেয়াল খুশির দৌড় দিচ্ছে তারা, কখনো আবার টুপ্ করে ঢুকে পড়ছে বালির গর্তে। মজাদার এইসব দৃশ্য চুটিয়ে উপভোগ করে ফিরে এলাম হোটেলে।
সে রাতটা বাঁকিপুটে কাটিয়ে পরদিন সকালে যখন কলকাতা ফিরছি, তখন ফিরতে আর মন চাইছেনা। দূষণহীন, কোলাহলহীন এক অসাধারণ পরিবেশে শব্দ বলতে পেয়েছি শুধু তরঙ্গের সুরমূর্ছনা, আর অসংখ্য বিচিত্র পাখির সুমিষ্ট কলকাকলি। যেতে যেতে কেন জানিনা আবারো, ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে নবকুমারের উক্তিটাই মনে পড়ছিলো ,’আহা, কি দেখিলাম !’