জন্মের স্মৃতিকথা

আমার জন্মতিথিতে সনাতন ধর্মের বিধবা-নারীদের ছিলো অম্বুবাচী।
চার দিন, চার রাত অগ্নিস্পর্শহীন
ফলমূল আর শুধু জল খেয়ে বাঁচা।
কী কঠিন! আহা, কী কঠিন!!

আমার সুন্দরী যুবতী বিধবা ঠাকুরমা
ও গ্রামের বিধবাকুল আমাকে
অম্বুবাচীর ঠাকুর বলে ডাকতেন।
আমিও সাড়া দিতাম তাদের আহ্বানে।

আমার বিধবা ধাইমা’র কাছে শোনা
পরের গল্পটা মিথ্যেও হতে পারে–,
মিথ্যে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

তবু তাঁর কাছে গল্পটা শুনেছি বলেই বলি…
শুকনো বাঁশের ধারালো ছিলকা দিয়ে
তিনি যখন আমার নাভি কাটছিলেন,
তখন একটা খুব ছোট্ট লাল মৌমাছি
আমার নাভির ভিতর থেকে বেরিয়ে
আঁতুর ঘরের বাইরে উড়ে গিয়েছিলো।

আমার ধাইমা খুব ভয় পেয়েছিলেন–,
ভেবেছিলেন, আমি হয়তো বাঁচবো না।
কিন্তু আমি দৈবকৃপায় বেঁচে যাই।

এই ঘটনাটির কথা বাবার কাছেও আমি
শুনেছিলাম এবং বিশ্বাসও করেছিলাম।
তিনি আমাকে নিয়ে শংকার মধ্যে ছিলেন।
ভেবেছিলেন, আমি হয়তো বাঁচবো না।
কিন্তু আমি দৈবকৃপায় বেঁচে যাই।

এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটির কথা না জেনেই
আমার জন্মদাত্রী জননী মারা যান।
তখন আমি নিজেই একটা ছোট্ট মৌমাছি,
আমার বয়স তখন হাজার দিনও হয়নি।

আমার বয়স যখন বারো কিম্বা তেরো,
তখন আমার ধাইমা একদিন
আমাকে নির্জনে পেয়ে
এই অলৌকিক ঘটনাটির কথা বলেন।
গল্পটা বলার সময় তিনি ভয়ে কাঁপছিলেন
এবং তাঁর চোখ ঘুঘুর চোখের মতো
ক্রমশ রক্তবর্ণ ধারণ করেছিলো।

গল্পটি শুনে আমি খুব শিহরিত বোধ করি।
স্বপ্নের ভিতরে আমি একটি ছোট্ট
লাল মৌমাছিকে দেখি। আমি ভয় পাই।

ঐ রাতেই আমার ধাইমা মারা যান।
সেদিন একটি ছোট্ট লাল মৌমাছিকে
আমি আমার চারপাশে উড়তে দেখেছি।
আমার মনে হয়েছিল, এই মৌমাছিটি
আমার জন্মসহোদর বা জন্মসহোদরা।

আমার মাথার চারিপাশে,
আমার দেহের চারিপাশে,
আমার চোখের চারিপাশে
ঐ ছোট্ট লাল মৌমাছিটি
এতো দ্রুতগতিতে ঘুরছিলো,
যে তার লিঙ্গনিরূপণ করা
আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
আমি সেই চেষ্টাও করিনি।

“জন্ম সহজ বাবা, জীবন কঠিন বড়ো”–
এই কথা বলে, এক মাঘীপূর্ণিমার রাতে
মৃত্যুরাষ্ট্রে পাড়ি জমান আমার বাবা।

সেদিনই ঐ ছোট্ট লাল মৌমাছিটিকে
আমি দেখেছি শেষবারের মতো।
তখন তার ঘূর্ণনগতির ধার কমে এসেছে।
ক্লান্তি এসে ভিড় করেছে
তার আকাশকাঁপানো ডানার পুলকে।

এই তিন-তিনটি মৃত্যুকে শিয়রে রেখে
আমি আজও বেঁচে আছি,
আর সম্ভবত আজও বেঁচে আছে
ঐ ছোট্ট লাল মৌমাছিটিও।

একদিন আমি তার দেখা পাবো–,
কেন পাবো না? নিশ্চয়ই পাবো।
এইরূপ বক্ষজোড়া তৃষ্ণা বুকে নিয়ে
আমি আজও মুহূর্তে-মুহূর্তে বাঁচি।

♥♥♥♥♥♥
১ অক্টোবর ২০২১।

Scroll to Top