তারুণ্যের কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন জন্মদিন সংখ্যা

বিক্ষত পদাবলি


মুক্তিযুদ্ধে বিক্ষত এ দেশ দেখলে মনে হতো
পা কেটে ফেলা কোনো অশত্থ
এলেন গিন্সবার্গ বলেছিলেন-
জমাটবাঁধা কান্নার পাহাড়
সেই কান্নার পাহাড় আরো উচুঁ হয়েছে
পঞ্চাশ বছর ধরে
সেই কান্নার পাহাড় থেকে এখন চুইয়ে নামছে আর্তনাদ
আর গল গল করে উঠছে মৃতদের অভিশাপ
কারা তৈরি করে দেয় বিভেদের বিভীষিকা
পীরগঞ্জের মাঝি পাড়ায় দুঃখে
দুমড়ে গেছে বৈঠা
রামুর মন্দিরে বেদনায় বোবা হয়ে গেছে সান্ধ্য ঘন্টা
রক্তে আরো পিছল হয়েছে দীঘির পাড়
চোখ বাঁধা মানুষের দীর্ঘ সারি
পাথরের পথে দাঁড়ানো হতবিহ্বল
এখনো কি আমরা- সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড
এখনো কি অসাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠেনি সংবিধান
যারা বাতাস নিংড়ে তৈরি করে সম্প্রীতি
বিশ্বাস থেকে ছড়ায় আজান
কথা ছেঁকে তৈরি করে স্তোত্র
তাদেরই আত্মায় জ্বলে উঠলো অশনি
হাজার -পাঁচশো
একশো কিংবা পঞ্চাশ বছর
আমাদের খেরো খাতায় লেখা পদাবলি-
আজ ধর্মান্ধতার বলি
শয়তানের ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলছে
আমাদের আত্মত্যাগ ।

ভবিষ্যদ্বাণী

আমরা জন্মের পর থেকে
বেরিয়ে পড়ি স্রষ্টার খোঁজে
একসময় বুঝতে পারি
তিনি মানুষের কৃতকর্মের
প্রতিধ্বনিতে থাকেন
ভাগ্যের আর্তস্বর থেকে পালিয়ে
ছুটে যাই ভবিষ্যদ্বক্তাদের কাছে
হাঁটতে থাকি আয়ুর বলিরেখার উপর
পরাজয়ের আশঙ্কায় জলাশয়ে নামি
বিজয়ের আনন্দে ঢুকি ট্রয় নগরীতে
ক্রীতদাসের হাসি আর গ্লানির দহন
তাড়িয়ে নেয় নিয়তির দিকে
স্বপ্নবিক্রতা জানে
কল্পরাজ্যে কত পাখি ওড়ে
আর নতুন স্বপ্নের সাথে
পুরানো স্বপ্ন জুড়ে দিলে
কেন সেতু ভেঙে পড়ে
নিরবতা কি হারানো
স্মৃতির স্বর্গে নিয়ে যায়
স্রষ্টার বাস অলিম্পাস পাহাড়
নাকি সমুদ্রের তলে
কেনো খোলা জানালায় গেলে
তার কণ্ঠস্বর শুনি
বাঁচার সংগ্রামে নিশ্চয়তা কে দেবে
স্রষ্টা না প্রশ্নকারী
সত্যিকার ভবিষ্যদ্বাণী হলো
একদিন তোমার মৃত্যু হবে ।

ভার্চুয়াল প্রেমের পদ্য

আজকে আমার সময় ছিলো
একটু যদি আসতে,
দেখতে কেমন দক্ষ আমি
তোমায় ভালোবাসতে।
এখন জানি কেমন করে
পড়তে হবে নামতা,
বলতে হবে সপ্রতিভ
হাসির কত দাম’তা।
বাদশা নই তবুও জানি
কোষাগারের মর্ম,
মনের সাথেই মোহরানা
পরিশোধের ধর্ম।
কফি এবং জুসের পাশে
মানায় কেমন খাদ্য,
বাজবে কি’না রবীন্দ্রনাথ
লাতিন কোনো বাদ্য?
ছেঁদো কথায় মস্ত ফাঁকি
ওসবে নেই বান্দা,
কিংবা ছলে চুমু খাওয়ার
মোটেও নেই ধান্দা।
তোমার প্রতি নিবেদিত
দু’এক লাইন পদ্য,
পড়তে পারি কথার ছলে
লিখেছিলাম সদ্য।
চেনোতো সব হাফিজ রুমি
সাদি এবং নজরুল,
ভার্চুয়ালি এনে দিতো
প্রিয়তমার নাক ফুল।
কিন্তু আমি সজাগ আছি-
অনলাইনে পণ্য,
পছন্দ তাই কিনছো দ্রুত
ধন্য তুমি ধন্য।
আজ বিকেলে সময় ছিলো
একটু যদি আসতে,
দেখতে কেমন ব্যাকুল আমি
তোমায় ভালোবাসতে।

আমি মাতাহারি

আমার চোখ বাঁধা থাকবে না
ফায়ারিং স্কোয়াডের অন্ধকার ভেদ
করে জ্বলে উঠলো তার কণ্ঠ
নিজের কাছে স্বগতোক্তি –
আমি মাতাহারি-আমি নিরপরাধ
জানি অভিযোগগুলো সাজানো
আইনগুলো বানানো
হিংসারা হিংস্র
গুপ্তচর আর যৌনতার অভিযোগ প্রহসন
ভাবি কত নিরপরাধী হয়েছে ডাইনি আর
পুড়িয়ে মেরেছে বীরপুরুষেরা
কারাকক্ষে স্মৃতি ছিলো একমাত্র সহায়
তারুণ্যে রুটি তৈরির গন্ধে আমি ছিলাম বুঁদ
এই পুরুষ পীড়িত সমাজে
অপরাধ মেনে নেয়া মুক্তির উপায়
বড় লজ্জার কথা গণতান্ত্রিক ইউরোপ
মুক্তকণ্ঠ আর নারী স্বাধীনতার
ঈর্ষায় খাক হয়ে যাওয়া ইউরোপ
খুঁজে পেয়েছে অপরাধ আমার সৌন্দর্য আর প্রতিবাদে
আমার দেহের ভাঁজে
দৌড়ে বেড়ায় যাদের ললুপ আকাঙ্খা
সকাল সন্ধ্যা তীব্র হয় তাদের মনোযোগ
না পাওয়ার বেদনায় তৈরি হয় ধারণাপত্র
আর বলে- মাতাহারি দেশের মাথা
কেটে উপহার দেবে জার্মানদের
সৌন্দর্য আর দেশপ্রেমের অপরাধে অভিযুক্ত

ক্লিওপেট্রার কথা আজ খুব মনে পড়ছে-
হা হতোষ্মি
আমি মাতাহারি এক নাইটিংগেল
বুকের রক্তে ফুটিয়েছি রক্তের নীল গোলাপ
আমি জ্বলছি জন্ম থেকে
তবু পরাজিত হইনি কখনো
এমনকি এই পাতানো মৃত্যুমঞ্চেও না
বরং বিচারের পরাকাষ্ঠায় দাঁড়িয়ে
হেসে উঠছি হা হা -পৃথিবী দেখুক
নগ্ন আদিম স্তনের অন্ধকারে
উদ্ধত নিরাপোষ এক নারী
মাতাহারি ।

শহরের সব গলিতে

সব শহরের থাকে আশ্চর্য গলিপথ
থাকে দাঁত উঁচু দোকান
ফেরিওয়ালার ফন্দিফিকির
ভিখারিদের একঘেয়ে অনুনয়
লোহা আর সোনা পেটানো গান
গলির বুক বরাবর কাপ -চামচের দ্বৈরথ
শেষ মাথায় মধ্যবয়স্কাদের কণ্ঠের বারুদ
আর আরব্য রজনীর অনি:শেষ গল্প
ধু ধু বিকেলে এক তরুণ
বিরহ পায়ে হাঁটে
জানালার মরুপথে তরুণী
শহরের সব গলিতে জুলেখা থাকে
আর এক স্বপ্নদ্রষ্টা ইউসুফ।

খনি শ্রমিক

একজন সোনার খনির শ্রমিক
ধীরে ধীরে সোনা হয়ে যায়
উদয়াস্ত নগ্ন সে ঢোকে
এক অজানা ধাঁধায়
তার খাদ্য বাইশ ক্যারেটের কুইজ
আর পানীয় গলিত রহস্য
হৃদয় ধাতুচুল্লির জাদু
শিরায় বয়ে যায় রহস্য সিরিজ
খনি শ্রমিকের দেহে আর
রক্ত থাকে না
সোনার ঘাম ছাড়া ।

পুনর্জন্ম

যদি আবার জন্মাই
ভালোবেসে বৃক্ষ হবো-পাতার বিনয়
ঘাস হবো নিরন্তর-পায়ের আশ্রয়
ভালোবেসে বাতাসের বেগ হবো
চুলের আকাশে বিদ্যুৎ
বিরহে পাথর হবো প্রাগৈতিহাসিক
সমুদ্র উজাড় করে-
অমৃত রাখবো পায়ে চাওয়ার অধিক
বৃষ্টি হয়ে ধুয়ে দেবো বিষ
মানুষ হয়ে জন্মালে আবার
একেঁ দিও কপালে উষ্ণীষ ।

কবি ও ঈশ্বর

ভাষা হলো প্রকাশের ইচ্ছা
স্বাধীনতা সামান্য সাহস
কবিতা আত্মার সৌন্দর্য
আর স্বর্গ ঈশ্বরের
কবি ও ঈশ্বরের পথ আলাদা
কিন্তু দরোজা একটাই ।

হিসেবের খাতা

সবকিছু দিয়ে দিয়েছি আমি
ভুবন চিলের ঠোঁটে ডাকঘুড়ি
প্রজাপতির ডানায় কৈশোরের
ছবি আঁকার খাতা
উৎসবের জামা হরিণের গায়ে
কাঠি লজেন্স নিয়ে কাক বসে আছে
সুতোর উপর
বন্ধুর চোখ রক্তের শিশিরের মধ্যে
প্রিয় বৃষ্টি বিশ্রাম নিচ্ছে জানালায়
বিস্ময় গেছে দিগন্তে
অর্জিত সব স্বপ্ন সময়ের করতলে
সূর্য বিলি করছে জমানো আকাংখা
চাঁদ বাড়ি ছেড়েছে অনেক আগেই
পিঁপড়েরা কোথায় লুকালো
হিসেবের খাতা
খুঁজতে শুকনো পাতার উপর
দিয়ে হাঁটছি
পৃথিবীর শেষ প্রান্তে ।

আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলে

পৃথিবীর একটা নিয়ম আছে
যুক্তিসংগত – বিস্ময়কর
আমরা যখন মহাকাশ- সমুদ্র কিংবা
পাহাড়ের বিশালতা দেখি
আনত হই এবং চিন্তাকরি প্রতিদানের
যদি এই অপার জগৎ অনুরণিত
না হয় রক্তে ও হৃদয়ে
যদি নুয়ে না আসে কৃতজ্ঞতা
জন্ম তবে দিকভোলা পাখি
যারা বিস্ময়ের অনুসন্ধান করে
তারাই বাস কর স্বর্গে
বসন্তের বাতাস কানে -কানে কথা বলে
তারা চোখ ছাড়াই সবকিছু দেখে
শুকনো পাতা আবার সবুজ হয়ে ওঠে
ঝড়ে ভাঙা গাছ গৌতমের ছায়া দিতে
কোমর সোজা করে দাঁড়ায়
পাহাড় হাসিমুখে মহত্তম বাণীবাহককে
দরোজা খুলে দেয়
শিশুর কোমল পায়ের নিচে
মরুভূমি ছড়িয়ে দেয় ঝর্ণা
আকাশ ক্ষুধার্তদের জন্য
পাঠায় সুস্বাদু শিশির
অস্তিত্ব হলো সত্যের তলদেশ
আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলে
মৃত্যুও মহৎ হয়ে ওঠে

Scroll to Top