ভিনসেন্টের মৃত্যু : কিছু প্রশ্ন!

ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ তাঁর ৩৭ বছরের জীবনে প্রায় ৯০০ ছবি ক্যানভাসে এঁকেছেন, আর ১১০০ ড্রইং করছেন কাগজে। মোট ২০০০ টি শিল্পকর্মের মধ্যে জীবদ্দশায় একটি মাত্র ছবি বিক্রি হয়েছিল (The Red Vineyard at Arles)। ছবিটি কিনেছিলেন বেলজিয়ামের একজন মহিলা (Anna Boch), তিনি নিজেও ছবি আঁকতেন ইমপ্রেসনিস্ট স্টাইলে। হয়তো নিজে আর্টিস্ট বলেই অন্যান্যরা পাত্তা না দিলেও ভিনসেন্টের ছবির মর্ম কিছুটা হলেও তিনি বুঝেছিলেন। সে সময় ঐ ছবিটি কিনেছিলেন ৪০০ ফ্রাঁতে।

পৃথিবীর সেরা ‘ছবির দেশ’ ফ্রান্স। সেরা ছবির শহর বলা হয় প্যারিস কে। সে যুগে প্যারিস শহরে কোনো আর্টিস্ট ছবি আঁকার সুযোগ পেলে বর্তে যেতেন। পৃথিবীর তাবৎ বিখ্যাত শিল্পীদের শিল্পকলার বিকাশ প্যারিস শহরকে ঘিরে। ভ্যানগঘও তাঁর শিল্প সম্ভার মেলে ধরার সুযোগ পেয়েছিলেন সে শহরে। কিন্তু শিল্প কলায় এমন সমৃদ্ধ দেশ, এমন সমৃদ্ধ শহরও ভ্যানগঘের মতো শিল্পীকে জীবদ্দশায় কেন চিনতে পারেনি, এটা বিশ্ময়!

জীবদ্দশায় প্রায় দু হাজার শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেও একটা মাত্র শিল্পকর্ম বিক্রি হয়েছিল। সারা জীবন ভাই থিও ভ্যানগঘের আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভর করে যাঁকে শিল্পচর্চা চালিয়ে যেতে হয়েছে। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে প্রায় উন্মাদ অবস্থায় আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়েছিল (২৯ জুলাই, ১৮৯০)। যদিও ‘লাভিং ভিনসেন্ট’ ছবিতে একটি তথ্য আছে। তাতে জানা যায় ভিনসেন্ট’কে অন্য একজন গুলি করেছিল (২৭ জুলাই, ১৮৯০)। দু দিন পর ভ্যানগঘের মৃত্যু হয়!

এ রকম একজন ‘ব্যর্থ শিল্পী’কে এখন কিন্তু পৃথিবীর সেরা শিল্পীর সম্মান দেওয়া হয়। ‘লাভিং ভিনসেন্ট’ ছবিটিও তার অন্যতম প্রমান। কয়েক শত শিল্পী দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে যে ভাবে একজন শিল্পীর জীবন তুলে ধরেছে তা পৃথিবীতে আগে কখনো ঘটেনি। এর থেকে বড় পাওয়া একজন শিল্পীর জীবনে আর কি হতে পারে?

তাঁর এক একটা ছবি এখন রেকর্ড দামে অকশানে বিক্রি হয়। অথচ একদিন ‘ছবির দেশে’ পাত্তাই পাননি ভিনসেন্ট। হতাশায় অকালে বিদায় নিতে হয়েছিল! আজ যদি প্রশ্ন তুলি, ছবির দেশের এই নিঃস্পৃহতা ভিনসেন্টের মৃত্যুর অন্যতম কারণ, অন্যায় হবে?

অন্যন্যরা আমার সঙ্গে সহমত হবেন কিনা জানিনা। আমার মনে হয় ভ্যানগঘের ছবির মধ্যে একটা টেনশন থাকতো। ছবির প্রতিটি স্ট্রোকের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকতো যন্ত্রনা, কষ্ট, অস্থিরতা। ইমপ্রেসনিস্ট অনেক শিল্পীর কাজে এ ভাব থাকলেও ভ্যানগঘ অনেকটাই যেন ব্যতিক্রম। আপাত প্রাকৃতিক হয়েও যা প্রকৃতির সুন্দর রূপ নয়। প্রতিটি স্ট্রোক যেন মাতালের মতো টালমাটাল, চলায়মান। এমনকি ড্রইং-র লাইনও যেন গতিশীল। এঁকে বেঁকে চলছে। যা হয়তো তখনকার রক্ষনশীলতাকে আঘাত করেছে। ব্যঙ্গ করেছে! সে সময়ের সনাতনে বিশ্বাসী প্যারিসবাসীর শিল্পরসিকগণ যার রস গ্রহন করতে পারেননি! একটু গভীরে তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে জীবদ্দশায় যাঁরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, বা পান, তাদের কাজ আপাত টেনশন, যন্ত্রনাময় মনে হলেও ভেতরে ঘুমিয়ে থাকে একটা মিষ্টি, নির্মল, নিশ্চিন্ত ভাব। যা সমাজের পক্ষে কাঙ্ক্ষিত! চোখের পক্ষে আরামদায়ক, দেওয়ালের পক্ষে উপযুক্ত। কিন্তু ভ্যানগঘ সে ফাঁকি শেখেননি। বা তাঁর স্বভাবের মধ্যেই এটা ছিলনা। ছিল যে না তাঁর ছবি গভীরভবাবে নিরিক্ষণ করলেই বোঝা যায়। যাঁরা তাঁর একটু আধটু জীবন কাহিনি জানেন বা তাঁর লেখা চিঠিগুলি পড়েছেন কিছুটা অনুভব করতে পারবেন।  

তাঁর জীবনযন্ত্রনা, ব্যর্থ প্রেম, কামনা, ভালোবাসা সব উজাড় হয়ে ঝরে পড়েছে যেন ছবিতে। রুঢ় ভাবে বলা যেতে পারে বমি করে দিয়েছেন যেন ক্যানভাসে। জীবন যন্ত্রনার বমি কার ভালো লাগে?

যাঁর গোটা জীবন লাথ খাওয়া (এ ভাষা ব্যবহারের জন্য আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি) ব্যর্থতা, যন্ত্রনায় জর্জর বমি মানুষকে আনন্দ দিতে পারে? তৎকালীন প্যারিসবাসীকেও দেয়নি। দিলে হয়তো পৃথিবী আরও বহু কিছু পেত ভ্যানগঘের থেকে। অকালে হয়তো তাঁকে ঝরে যেতে হতোনা।

আবার উল্টোটাও বলা যায়, এই লাথ খাওয়া জীবনযন্ত্রনা ভিনসেন্টকে ক্ষুরধার করেছে। ছবির আঁচড়ে ধরা পড়েছে ক্ষতবিক্ষত জীবন। জীবনের অস্থিরতা, যন্ত্রনা, হতাশা, টালমাটালতা। তাই তো জীবন শিল্পী হয়ে আজও আমাদের হৃদয়ে জায়গা জুড়ে আছেন। না হলে হয়তো শুধু ‘সুন্দর’ হয়েই থেকে যেত তাঁর ছবি!

কিন্তু তাঁর মৃত্যু পরবর্তী অধ্যায়ে পৃথিবী দেখতে পেত এমন জীবন যন্ত্রনার প্রতিচ্ছবি? পাওয়ার সম্ভবনা বোধহয় ছিলই না যদিনা দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কোনও এক রমনী বুক আগলে বাঁচিয়ে রাখতেন ভিনসেন্ট ভ্যানগঘের ছবি।

তাঁর নাম জোহানা ভ্যানগঘ। ভিনসেন্ট ভ্যানগঘের ভাই থিও ভ্যানগঘের স্ত্রী।

ভিনসেন্ট ভ্যানগঘের ভাই থিও ভ্যানগঘের সঙ্গে তাঁর বিয়ের মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ভাসুর ভিনসেন্ট আশ্চর্যজনকভাবে চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। ভাসুরের মৃত্যুর মাত্র ৬ মাস পরে স্বামী থিও ভাইয়ের পথেই পাড়ি দিলেন।

জোহানা কি চিত্রকলার আদৌ কিছু বুঝতেন? একদা চিত্রসমালোচকদের আলটপকা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হতে হয়েছে তাঁকে। নির্বাক হতাশ হয়ে চুপ থেকেছেন। সময়ই অবশ্য শেষ উত্তর শুনিয়েছে। ভিনসেণ্টের আত্মা কি শান্তি পেয়েছে? থিও কি ওপর থেকে দেখতে পেয়েছে সবটুকু? স্টারি স্টারি নাইটস…উত্তর হয়তো লুকিয়ে আছে ঐ নীল আকাশের গায়ে হলুদ রঙা তারাদের মাঝে?

থিও, তাঁর স্বামী যখন মারা গেলেন, কোলের দুই বছরের কচি বাচ্চাটিকে নিয়ে তিনি একরকম দিশেহারা। সম্বল বলতে পারির ছোট্ট কোঠায় কটি কাঠের আসবাব আর শ’দুয়েক অ-বিক্রীত ছবি। সবই তাঁর সেই ‘পাগল’ ভাসুরকর্তার আঁকা। আর হ্যাঁ, কিছু চিঠিও ছিল বটে! তাঁর স্বামীকে লেখা ভাসুরঠাকুরের যত চিঠি। দুটি ভাই যেন দুটি বন্ধু! ভাই বয়সে ছোট হলেও, দাদার সহায় সম্বল বলতে সবই তো তিনিই। না, থিও মানুষ হিসেবে সত্যিই বড় ভালো, বড় উদার ছিলেন! অন্ধের মতো দাদাকে স্নেহ করতেন, আগলে রাখতেন মানুষটাকে। উনি তো ছবিআঁকা বুঝতেন! চিত্রকলার বুঝদার হিসেবেই তো আর্টডিলারের পেশায় ভিড়েছিলেন থিও! কিন্তু ভাইয়ের মৃত্যু-শোক তাঁকে বেশিদিন পৃথিবীতে থাকতে দিল না।  

মাত্র দুবছরের দাম্পত্য জীবনে এটুকু অন্তত বুঝেছিলেন জোহানা, তাঁর ভাসুরঠাকুরের আঁকা ছবি বিক্রিবাটা না হলেও, তিনি একজন সত্যিকারের জিনিয়াস! থিওর কথা কি ভুল হতে পারে? অসম্ভব।

পারি ছেড়ে আমস্টারডামে ফিরে এলেও, ঐ সব ছবি, চিঠিপত্র তাই ফেলে আসতে পারেননি জোহানা। কতজনে পরামর্শ দিয়েছে, “ঐ আবর্জনা বয়ে নিয়ে গিয়ে হবেটা কি? ওজনদরে বেচে দাও বরং। বাক্স প্যাঁটরা হালকা হবে।”

আহা! তা কি হয়? স্মৃতিচিহ্ন। তাঁর থিওর এত প্রিয়, এত আদরের দাদার আঁকা ছবিগুলি তিনি কি করে ফেলে আসতে পারেন?

আমস্টারডামে ফিরে নানা কাজে জড়িয়ে পড়লেও, জোহানা কিন্তু ভোলেননি ছবিগুলি। আর তাঁর স্বামীকে লেখা ভিনসেণ্টের চিঠিগুলি। চেষ্টা চালিয়ে গেছেন কোথাও কোনও প্রদর্শনীতে ছবিগুলি দেখানোর। কত কটুকথা সহ্য করতে হয়েছে! লোকে ঠাট্টা করেছে। হাল ছাড়েননি জোহানা। একমনে সমস্ত চিঠিগুলিকে সাজিয়েছেন, দরকারি নোট নিয়েছেন। শেষমেশ প্রকাশও করেছেন বই আকারে। প্রথমটায় অত হৈচৈ না হলেও ধীরেধীরে মানুষ বুঝতে শুরু করেছে।

আজ ভিনসেণ্ট ভ্যানগগ বিশ্বের চিত্রকলার ইতিহাসে সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভাগুলির অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। জোহানা ভ্যানগগ কি তাঁর অবদানের স্বীকৃতি পেয়েছেন? না, তা হয়ত পাননি। তাতে কি আসে যায়! তাঁর উদ্যোগ স্বার্থক হয়েছে।

ভিনসেন্ট ভ্যানগগ এ বিশ্বের সবচাইতে হতভাগ্য প্রতিভা। জীবৎকালে যাঁর একটি মাত্র ছবি বিক্রি হয়েছিল! অথচ আজ তাঁর একটি ছবি নিজেদের সংগ্রহে রাখতে সর্বস্ব পণ করে বসেন শৌখিন চিত্র সংগ্রাহকের দল।

মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যিই যদি সেদিন ‘ছবির দেশ কবিতার দেশ’ বুঝত ভিনসেন্টকে, শিল্পের ইতিহাস বোধহয় অন্যভাবে লেখা হতো। 

Scroll to Top