মহান বিজয় দিবস শামসুর রাহমান সংখ্যা

আসাদের শার্ট

গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায় ।

বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে ।

ডালীম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর- শেভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায় ।

আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক ;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা ।

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,

সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিত্কার করতে করতে
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভূর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুড়ো
উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে
নড়বড়ে খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী ব’লে নৌকা চালায় উদ্দান ঝড়ে
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুড়ে বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হ’তে চলেছে —
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
মতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।

বন্দী-শিবির থেকে

ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি
তোমাদের আজ বড়ো ঈর্ষা করি | তোমরা সুন্দর
জামা পরো, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও,
কখনো সেজন্য নয় | ভালো খাওদাও
ফুর্তি করো সবান্ধব, সেজন্যেও নয় |

বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,

স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে
আমি বড়ো ঈর্ষান্বিত আজ |
যখন যা খুশি
মনের মতন শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার
তোমরা সবাই |
যখন যে-শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে,
কখনো অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো-বা |
সেসব কবিতাবলী যেন রাজহাঁস,
দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানুষের
অত্যন্ত নিকটে যায়, কুড়ায় আদর
অথচ এ দেশে আমি আজ দমবন্ধ
এ বন্দী-শিবিরে
মাথা খুঁড়ে মড়লেও পারি না করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোনো |
মনের মতন সব কবিতা লেখার
অধিকার ওরা
করেছে হরণ |
প্রকাশ্য রাস্তায় যদি তারস্বরে চাঁদ ফুল পাখি
এমন কি ‘নারী’ ইত্যাকার শব্দাবলী
করি উচ্চারণ, কেউ করবে না বারণ কখনো |
কিন্তু কিছু শব্দকে করেছে
বেআইনী ওরা
ভয়ানক বিস্ফোরক ভেবে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি
ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ ক’রে বারবার
তৃপ্তি পেতে চাই | শহরের আনাচে কানাচে
প্রতিটি রাস্তায়
অলিতে গলিতে
রঙিন সাইনবোর্ডে, প্রত্যেক বাড়িতে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি
লিখে দিতে চাই
বিশাল অক্ষরে
স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার
কখনো জানি নি আগে | উঁচিয়ে বন্দুক
স্বাধীনতা, বাংলা দেশ—- এই মতো শব্দ থেকে ওরা
আমাকে বিচ্ছিন্ন ক’রে রাখছে সর্বদা |

অথচ জানে না ওরা কেউ
গাছের পাতায়, ফুটপাতে
পাখির পালকে কিংবা নারীর দু-চোখে
পথের ধুলোয়,
বস্তির দুরন্ত ছেলেটার
হাতের মুঠোয়
সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি |

বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা 

নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।
মমতা নামের প্রুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে
শিউলিশৈশবে ‘পাখী সব করে রব’ ব’লে মদনমোহন
তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,
অবিচ্ছিন্ন পরস্পর মমতায় লীন,
ঘুরেছি কাননে তাঁ নেচে নেচে, যেখানে কুসুম-কলি সবই
ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সংকেতে।

আজন্ম আমার সাথী তুমি,
আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গ’ড়ে পলে পলে,
তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে
আমারই বন্দরে।

গলিত কাচের মতো জলে ফাত্না দেখে দেখে রঙিন মাছের
আশায় চিকন ছিপ ধরে গেছে বেলা। মনে পড়ে কাঁচি দিয়ে
নক্সা কাটা কাগজ এবং বোতলের ছিপি ফেলে
সেই কবে আমি হাসিখুশির খেয়া বেয়ে
পৌঁছে গেছি রত্নদীপে কম্পাস বিহনে।

তুমি আসো আমার ঘুমের বাগানেও
সে কোন্ বিশাল
গাছের কোটর থেকে লাফাতে লাফাতে নেমে আসো,
আসো কাঠবিড়ালির রূপে,
ফুল্ল মেঘমালা থেকে চকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ো ঐরাবত সেজে,
সুদূর পাঠশালার একান্নটি সতত সবুজ
মুখের মতোই দুলে দুলে ওঠো তুমি
বার বার কিম্বা টুকটুকে লঙ্কা ঠোঁট টিয়ে হ’য়ে
কেমন দুলিয়ে দাও স্বপ্নময়তায় চৈতন্যের দাঁড়।

আমার এ অক্ষিগোলকের মধ্যে তুমি আঁখিতারা।
যুদ্ধের আগুণে,
মারীর তাণ্ডবে,
প্রবল বর্ষায়
কি অনাবৃষ্টিতে,
বারবনিতার
নূপুর নিক্কনে
বনিতার শান্ত
বাহুর বন্ধনে,
ঘৃণায় ধিক্কারে,
নৈরাজ্যের এলো-
ধাবাড়ি চিত্কারে,
সৃষ্টির ফাল্গুনে

হে আমার আঁখিতারা তুমি উন্মিলিত সর্বক্ষণজাগরণে।

তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার ?
উনিশ শো’ বাহন্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।
সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হ’লে আমার সত্তার দিকে
কতো নোংরা হাতের হিংশ্রতা ধেয়ে আসে।
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস !
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।

উদ্ধার 

কখনো বারান্দা থেকে চমত্কার ডাগর গোলাপ
দেখে, কখনো বা
ছায়ার প্রলেপ দেখে চৈত্রের দুপুরে
কিংবা দারুমূর্তি দেখে সিদ্ধার্থের শেল্ ফ-এর ওপর
মনে করতুম,
যুদ্ধের বিপক্ষে আমি, আজীবন বড়ো শান্তিপ্রিয় |
যখন আমার ছোট্ট মেয়ে
এই কোণে ব’সে
পুতুলকে সাজায় যতনে, হেসে ওঠে
ভালুকের নাচ দেখে, চালায় মোটর, রেলগাড়ি
ঘরময়, ভাবি,
যুদ্ধের বিপক্ষে আমি, আজীবন বড়ো শান্তিপ্রিয় |
যখন গৃহিণী সংসারের কাজ সেরে
অন্য সাজে রাত্রিবেলা পাশে এসে এলিয়ে পড়েন,
অতীতকে উসকে দেন কেমন মাধুর্যে
অরব বচনাতীত, ভাবি—–
যুদ্ধের বিপক্ষে আমি, আজীবন শান্তিপ্রিয় |
আজন্ম যুদ্ধকে করি ঘৃণা |
অস্ত্রের ঝনঝনা
ধমনীর রক্তের ধারায়
ধরায় নি নেশা কোনোদিন
যদিও ছিলেন পিতা সুদক্ষ শিকারী
নদীর কিনারে আর হাঁসময় বিলে,
মারিনি কখনো পাখি একটিও বাগিয়ে বন্দুক
নৌকোর গলুই থেকে অথবা দাঁড়িয়ে
একগলা জলে | বাস্তবিক
কস্মিনকালেও আমি ছুঁই নি কার্তুজ |

গান্ধিবাদী নই, তবু হিংসাকে ডরাই
চিরদিন ; বাধলে লড়াই কোনোখানে
বিষাদে নিমগ্ন হই | আজন্ম যুদ্ধকে করি ঘৃণা |
মারী আর মন্বন্তর লোক শ্রুত ঘোড়সওয়ারের
মতোই যুদ্ধের অনুগামী | আবালবৃদ্ধবনিতা
মৃত্যুর কন্দরে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে
অবিরাম | মূল্যবোধ নামক বৃক্ষের
প্রাচীন শিকড় যায় ছিঁড়ে, ধ্বংস
চতুর্দিকে বাজায় দুন্দুভি |
আজন্ম যুদ্ধকে করি ঘৃণা |

বিষম দখলীকৃত এ ছিন্ন শহরে
পুত্রহীন বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে জিগ্যেস করুন,
সৈনিক ধর্সিতা তরুণীকে
জিগ্যেস করুন,
কান্নাক্লান্ত সদ্য-
বিধবাকে জিগ্যেস করুন,
যন্ত্রণাজর্জর ঐ বাণীহীন বিমর্ষ কবিকে
জিগ্যেস করুন,
বাঙালি শবের স্তূপ দেখে দেখে যিনি
বিড়বিড় করছেন সারাক্ষণ, কখনো হাসিতে
কখনো কান্নায় পড়েছেন ভেঙে—-তাকে
জিগ্যেস করুন,
দগ্ধ, স্তব্ধ পাড়ার নিঃসঙ্গ যে-ছেলেটা
বুলেটের ঝড়ে
জননীকে হারিয়ে সম্প্রতি খাপছাড়া
ঘোড়ে ইতস্তত, তাকে জিগ্যেস করুন,
হায়, শান্তিপ্রিয় ভদ্রজন,
এখন বলবে তারা সমস্বরে যুদ্ধই উদ্ধার |

প্রত্যাশার বাইরেই ছিল

প্রত্যাশার বাইরেই ছিল ব্যাপারটি। রোজকার
মতোই টেবিল ঘেঁষে পুরোনো চেয়ারে
আরামে ছিলাম বসে, ঘড়িতে তখন
আমি কি না-লেখা কোনও কবিতার পঙ্‌ক্তি মনে-মনে
সৃজনে ছিলাম মগ্ন? একটি কি দুটি শব্দ হয়তো-বা ভেসে
উঠছিল আমার মানস-হ্রদে। আচমকা
চোখে পড়ে ঘরে একটি প্রজাপতির চঞ্চলতা।

বেশ কিছুকাল থেকে কৃষ্ণপক্ষ দিব্যি গিলে রেখেছে আমার,
আমাদের বসতিকে। আলো জ্বালাবার
প্রয়াস নিমেষে ব্যর্থ হয় জাহাঁবাজ
তিমিরবিলাসী ক্রূর হাওয়ার সন্ত্রাসে নিত্যদিন। তবুও তো

একজন রঙিন অতিথি ঘরটিকে দান করে অকৃপণ
সোন্দর্যের আভা, মুগ্ধ চোখে দেখি তাকে। মনে হয়,
একটি কবিতা যেন ওড়াউড়ি করছে এ-ঘরে,
অথচ দিচ্ছে না ধরা আমার একান্ত করতলে, যার ধ্যানে
দীর্ঘকাল মগ্ন ছিল কবিচিত্ত সম্ভবত অবচেতনায়
আধো জাগরণে কিংবা ঘুমের আংশিক এলাকায়।

(ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)

কখনো আমার মাকে

কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।

যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার আসেনি,
যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানো
বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোনো গান
লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়,
পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং স্বামীর

সংসারে এসেও মা আমার সারাক্ষণ
ছিলেন নিশ্চুপ বড়ো, বড়ো বেশি নেপথ্যচারিণী। যতদূর
জানা আছে, টপ্পা কি খেয়াল তাঁকে করেনি দখল
কোনোদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে
অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন
ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন
সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়,
ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে
আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে
অবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোনো গান গেয়েছেন কি না
এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি।

যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ ক’রে আজীবন, এখন তাদের
গ্রন্থিল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে !





শামসুর রাহমানের কবিতা : আধুনিকতা ও অস্তিত্বচেতনা

সুহিতা সুলতানা

কবিতা নির্মাণের প্রকরণগত স্বরূপ নির্ণয়, আমাদের ভাষার অভিনব শিল্প-প্রক্রিয়া, নির্দিষ্ট বাচন-ভঙ্গি, মনোজগতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতির ঝলমলে রহস্যময় জাগতিক উৎস সন্ধান, নাগরিক জীবনবোধ, আধুনিক চিন্তননির্ভর কবিতায় শব্দের নতুনত্ব, কবিতায় নিমগ্নতার ইতিহাস এবং শিল্পের বিশাল প্রাঙ্গণ শামসুর রাহমানের কবিতাকে ঘিরে আবর্তিত। এভাবে ক্রমাগত শামসুর রাহমানের কাব্যতত্ত্বের গূঢ়রহস্য উন্মোচন করলে আধুনিক বাংলা কবিতার র্ফম কীভাবে তাঁর কবিতায় প্রযুক্ত হয়েছে তা অনুধাবন করা যায়।
আধুনিক বাংলা কবিতার নতুন বাঁক-নির্মাণে রবীন্দ্রনাথের পর শামসুর রাহমান বাংলাদেশের কবিতার ভুবনকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন। তিরিশের কবিদের ভাবনা-চিন্তনকে গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে শামসুর রাহমান নির্মাণ করেছেন কবিতার নতুন ধারা। ইউরোপীয় কবিতার ঢঙ ও বক্তব্যকে শামসুর রাহমান কখনো কখনো গ্রহণ করেছেন বটে বিপরীতভাবে বাংলা কবিতার পরিণ্ডলকে আধুনিকতার নতুন দিগন্ত নির্মাণে মগ্ন হয়েছেন। একথা যেমন সত্য রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতার প্রাঙ্গ অধীশ্বর। তেমনি শামসুর রাহমানও বাংলা কবিতার ভুবনকে আধুনিক ও অভিজ্ঞতাময় শৈল্পিক সুষমায় বহুমাত্রিকতা দান করেছেন।
শামসুর রাহমান সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে ও ভিন্ন মেজাজে কবিতা নির্মাণ করেন। প্রকৃতপক্ষে কবিতাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন। তিরিশের কবিবৃন্দের বলয় থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ আত্মমগ্নতার ভেতর দিয়ে নির্মাণ করেছেন কবিতার ভূমূণ্ডল। আধুনিক বাংলা কবিতার প্যার্টানকে দুর্বোধ্যতা কবিতার আত্মা যেমন সত্য, কল্যাণবোধ, মৌলিক ভিত্তি, চিরন্তন সকল সৌন্দর্যকে তিনি কবিতায় জীবনের নিগূঢ়তম অভীপ্সার দিগ্বলয় পর্যন্ত প্রসারিত করতে চান। তিনি সামাজিক স্বীকৃতি-নির্ভর এবং সচেতন পাঠকের মনোলোকের অস্তিত্বকে বিশুদ্ধ মননচর্চা দিয়ে তৈরি করেন কবিতার নতুন ভাব-অর্থব্যঞ্জনাময় জগৎ।
দ্বন্দ্ব-সংঘাত আতঙ্ক সমাজের পঙ্কিলতা মানুষের হীনম্মন্যতা এসব যেমন তাঁর কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ পাশাপাশি প্রকৃতির ভুবনে পরিভ্রমণ ও মনোজগতের মধ্যে আকাক্সক্ষাময় সূক্ষ্ম কাব্যিক উৎস ও প্রেরণা তিনি আবিষ্কার করতে চান রোমান্টিকতা ও মূল্যবোধের ভেতর দিয়ে। শৈল্পিক ভাষা সৃষ্টির একটি অভিনব কৌশলÑ শামসুর রাহমানের কবিতায় দেখা যায়। দর্শনলগ্ন তাৎপর্য শব্দ ও ভাষার জগৎকে অস্তিত্বময় করে বটে তবে জ্ঞানালোকে পৌঁছতে একজন মেধাবী পাঠককে প্রাণিত করে সন্দেহ নেই। শামসুর রাহমান ক্রমাগত মেধাবী পাঠককে নিয়ে যায় এক বিশাল কবিতার সাম্রাজ্যে তখন যেন কবির জীবনের দায়ভার বহন করতে হয় একজন পাঠককেই। আমাদের চলমান জীবনের উৎস ও ঐতিহ্য খুঁজতে গিয়ে আমরা কবির আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, দেশপ্রেম, রাজনৈতিক চেতনা, অস্তিত্বচেতনা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, ঘৃণা, দ্রোহ শামসুর রাহমানের কবিতায় খুঁজে পাই।
কবিতার নির্মাণকৌশল, নির্মাণপদ্ধতি এবং কবিতার উপকরণের ব্যবহার সর্বাগ্রে আমরা খুঁজে পেতে চেষ্টা করি। সমাজ, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চিত্র প্রত্যেক কবির ভাবনার ভেতরে সংযুক্ত হতে দেখা যায় এবং মানুষের অনুভূতিগুলো ক্রমশ আবদ্ধ থেকে কখনো সৌন্দর্যময় আবার কখনো সৌন্দর্যহীন হয়ে ওঠে। মানুষ মূলত একা। এই একাকিত্বকে সে নিজস্ব অবয়ব ও সৌন্দর্যে আবদ্ধ করে সম্পূর্ণ নিজস্ব বলয়ে প্রাণিত করে। আধুনিক কবিমাত্রই নিঃসঙ্গতার সুরা পান করতে চান তার মৌলিক প্রবৃত্তিসমূহ ও দৃষ্টিভঙিঙ্গকে উৎকর্ষিত করতে চান। আধুনিক চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ তার জীবনের সবকিছু বদলে ফেলতে চায়। তখন মানুষের পূর্ণাঙ্গ বোধ ধারণ করতে চায় শিল্প-সাহিত্যকে কেন্দ্র করে। আমাদের সামগ্রিক চেতনাবোধকে আমরা সুস্থতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে চাই। অঅমরা নির্মাণ করতে চাই বোধের জগৎ।

শামসুর রাহমান নাগরিক কবি। নগরজীবনের অসঙ্গতি, মধ্যবিত্তের দুঃসহ উপলব্ধি, হতাশা-ঘৃণা, অবিশ্বাস, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংস্কৃতির অবক্ষয়, ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্ব বিষয়ে সন্দিহহান, রিঢ়ংসা, প্রেম, রোমান্টিকতা, নির্বেদ থেকে উদ্ধারের প্রচেষ্টা, স্বাধীন চিন্তা, পরিবেশের বিচিত্র রূপান্তর, ব্যক্তির নতুন রূপ আবিষ্কার, প্রাণহীন শহরের পটভূমি, যৌবনের আত্মমগ্নতার জগৎ তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য।


জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু যাঁরা কবিতার নতুন দিন-নির্মাণের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছেন। মানুষের প্রয়াস সম্ভাবনা সমৃদ্ধ অনন্যতা তার সৃজনধর্মে প্রকাশ পায়। কবির নিজস্ব ভাবনা-চিন্তন, জাতিবাদ ব্যক্তির স্বকীয়তাকে বিলুপ্ত করতে চাইলে ও মনুষ্যত্বকে প্রধান করে ব্যক্তি অনন্যতাকে প্রশ্রয় দিতে চায়। মানবিক বিপর্যয়, ধারণা, দর্শন, চিন্তন, সামাজিক দায়বদ্ধতা, মোহমুক্তি, নগরযন্ত্রণা এসব কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে দ্বিধাহীনভাবে অনিবার্য হয়ে উঠেছে শামসুর রাহমানের কবিতার পটভূমি। কবিতার চিত্রকল্প ও শব্দের বিচিত্র সম্ভাবনা, প্রতিক্রিয়াগত আনন্দ ও হতাশার মধ্য দিয়ে এবং শুদ্ধতা জীবনের লক্ষ্য নির্ণয়ে আধুনিক কবিতা নির্মাণ করতে চান কেউ কেউ। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে শামসুর রাহমানের কবিতার বক্তব্য ঋজু ও রাজনৈতিকমনস্ক হতে দেখা যায়। কবিতার স্বতন্ত্র বৃত্ত নির্মাণ করেছেন তিনি। হেঁটেছেন কবিতার জন্য দীর্ঘপথ। মানুষের ভেতরের জগৎকে তিনি গভীরভাবে অবলোকন করতে চেয়েছেন। মুক্তি খুঁজেছেন কবিতায়। নিমগ্ন হয়েছেন অবিনাশী বর্ণমালায়।


আসলে আমরা কী চাই? পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্যকে গ্রহণ ও অবলোকনের মধ্য দিয়ে আমরা অতিক্রম করতে চাই দীর্ঘ পথ। আমাদের অগ্রসরমান চিন্তা দিয়ে আমরা আমাদের যাপিত জীবনের সকল সংকটকে সমাধান করতে চাই। আমরা পরিত্রাণ চাই অস্তিত্বের সংকট থেকে।


কবিতা কবির জীবনচেতনার সচেতন অভিব্যক্তি। তাঁর জীবনপ্রবাহ সমকালের অর্জিত সকল দ্বন্দ্ব ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রবহমান এটা অবশ্য কবির জীবন-সত্যের উপলব্ধি থেকে নির্মাণ করা সম্ভব। কবিতা আমাদের সামাজিক জীবনের প্রয়োজনীয় একটি মাধ্যম। ইতিহাস-ঐহিত্যপ্রসূত বস্তুজগৎ ও মনোজগতের মধ্যে কবির ভাবনার জগতে অনুপ্রবেশ। আধুনিক বাংলা কবিতার রূপরেখা অঙ্কনের প্রয়াস অস্তিত্বসচেতন ও সামগ্রিক প্রয়োজনবোধ নির্ণয় করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতায় আজও আধুনিক। তিনি আমাদের সাহিত্যে কতোখানি জায়গা জুড়ে আছেন তা পরিমাপ করা দুঃসাধ্য তো বটেই, তাঁর সমগ্র রচনা পাঠ করাটাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।


রবীন্দ্রনাথের শব্দাবলি সীমিত নয়, অনেক বেশি অর্থবহ। পূর্বেই বলেছি রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রচনা পাঠ করা সহজে সম্ভব নয়। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের আগমন সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য অহংকার। বাংলা সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডর তিনি যেন একাই পূর্ণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের নিকট আমাদের ঋণের শেষ নেই।


সকল ভাবের ঐশ্বর্য রবীন্দ্রনাথে। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে যা কিছু অর্জন সম্ভবপর হয়েছে তা রবীন্দ্রনাথের জন্যই। সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি করেছেন তিনি। আমাদের মৌলিক প্রবৃদ্ধিকে তিনি আরো উসকে দিয়েছেন। আমরা হয়ে উঠেছি সাহিত্যানুরাগী।


কবিতা হচ্ছে একটি সামাজিক দায়। যা থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে মানুষকে সচেতন ও সৃষ্টিশীল অস্তিত্বের বিশালতাকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলা।


বস্তুজগৎ, মনোজগৎ এবং সামগ্রিকভাবে সামাজিক বিবর্তনের নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি হচ্ছে কবিতা। বাংলা কবিতার অস্তিত্ব নির্মাণের কাঠামো পর্যালোচনা করতে গেলে মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলকে আমরা আমাদের ভাবনা ও অনুভবের মধ্যে নিয়ে আসি। আমাদের কাব্যভুবনে এই তিন কবিপুরুষের প্রতিভা নির্ণয় করা একটু দুঃসাধ্য। এই তিন কবিপুরুষ যথাক্রমে মহাকবি, বিশ্বকবি এবং বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। তবে বাংলা কাব্যসাহিত্যে একনায়কত্বের যুগ রবীন্দ্রনাথেই শেষ। কাল-পরিক্রমায় এর পরিসমাপ্তি ঘটলেও রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কাব্যে অভিনব এক ভাবের আধার তৈরি হয়েছে কয়েক যুগের কবিদের কাব্য সম্মিলনে। জীবনানন্দ দাশের পর বোধহয় শামসুর রাহমানই সফল কাব্যশিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, তাঁর বিচিত্র কাব্যসম্ভারের সাক্ষ্যে তা বলা যায়। বাংলাদেশের বিস্তৃত পরিধিতে শামসুর রাহমানের কবিতা পূর্বসূরিদের চাইতে বেশি পরিমাণে উন্মোচিত হয়েছে।


রবীন্দ্রবলয় থেকে মুক্ত হবার জন্য যাঁরা ব্রতী হয়েছিলেন সেই তিরিশের কবিদের কথিত রবীন্দ্রবিরুদ্ধতা সাড়া জাগিয়েছিল বটে; কিন্তু রবীন্দ্রপ্রতিভার কাছে ছিল তাঁরা অনেকেই নিষ্প্রভ। রবীন্দ্রনাথ আজও বাংলা কবিতার ভুবনকে আলোকিত করে রেখেছেন। তাঁর সংগীত যেন আমাদের চিরকালের সখা। তাঁর সংগীত ভাববোধ ও বেদনাবোধ, যা একই সঙ্গে রোমান্টিক আবহাওয়া তৈরি করে, ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে, সেদিন ভরা সাঁঝে’। রচনাভঙ্গিতে রোমান্টিক সুর পরিলক্ষিত করে, যাকে বলা যায় অভূতপূর্ব নির্বাহুল্য। তারপরও রবীন্দ্রবলয় থেকে তিরিশের কবিরা অন্য পথে হাঁটবার প্রয়াসী হয়েছেন। সম্পূর্ণ ইউরোপীয় ঢঙ এবং বাংলাভাষায় লালিত্যকে পাশ কাটিয়ে পাঠকের সামনে কবিতার নতুন একটি ভুবন তাঁরা নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। অপ্রাসঙ্গিকভাবে দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার অসফল রূপটি তাঁরা কবিতায় আরোপ করতে সচেষ্ট হলেন। সামাজিক কর্মক্ষেত্রের সকল ভ-ামিকে তিরিশের কবিরা শেকড়সমেত উপড়ে ফেলতে চেয়েছেন; এটা যেমন সত্য তেমন তাঁদের কাব্যভাবনা পর্যালোচনা করলে পাশ্চাত্য কবিতার একটি অবয়ব আমাদের চোখে পড়ে।


বিশ শতকের আধুনিক বাংলা কবিতা বাঙালির প্রতিভার বিকাশ ও মহত্তম সৃষ্টি একথা সদৃঢ়ভাবে বলা যায়। আধুনিক বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে বিশ শতক উল্লেরখযোগ্য। তারপর তিরিশের পাঁচজন প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু ও অমিয় চক্রবর্তী। এক দশকে পাঁচজন প্রধান কবির আবির্ভাব বিস্ময়কর তো বটেই, গুরুত্বপূর্ণও। আধুনিক বাংলা কবিতার উৎকৃষ্টতার বিচারে মধ্যযুগের যেকোনো ধারার কবিতা থেকে এঁদের কবিতা অনেক বেশি উজ্জ্বল ও অগ্রসরমান। তারপরও স্বীকার করতেই হয় মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ বাংলাকাব্যে আজও আধুনিক কবি হিসেবে খ্যাত।


উৎকৃষ্ট কবিতা সনাক্ত করা যায় কবির কাব্যগুণ বিচার করলে। পঞ্চাশের দশকের প্রধান কবিমাত্র দু’জন, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। এ দু’জন কবি আধুনিক বাংলা কবিতার ভুবনকে নতুন আঙ্গিক ও নতুন মাত্রা সংযুক্ত করেছেন। এঁদের পূর্ববর্তী কবি আহসান হাবীব, আবদুল গনি হাজারী, আবুল হোসেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, ফররুখ আহমদ কবিতার বিশেষ একটি দিক-নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। এঁদের মধ্যে আহসান হাবীব এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রর কবিতার বক্তব্য প্রখর ও বিশ্লেষণধর্মী। আহসান হাবীব সে সময় কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন লাভ ও কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু শিল্পগত নৈপুণ্য প্রদর্শন ও আধুনিক জীবনবোধের শিল্পক্রিয়া থেকে তিনি কিছুটা হলেও কবিসত্তার ভেতরে আবদ্ধ ছিলেন। চল্লিশের দশকের কবিতার একটি আলাদা ভুবন তৈরি হয়নি। তারপরও বলা যায়, আহসান হাবীবের কবিতায় নগরজীবনের নৈরাশ্য ও ক্লান্তি আমাদের চোখে ধরা পড়ে।


নাগরিক কবি হিসেবে আহসান হাবীবকে সনাক্ত করা যায়। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও মুগ্ধতা তাঁর ভেতরেও সমানভাবে আলোড়িত করেছে।


শামসুর রাহমান নাগরিক কবি হিসেবে এদেশের মানুষের ভেতরে নতুন দর্শন, জীবনবোধ, অনুভূতি, জিজ্ঞাসা সঞ্চরমাণ করেছেন। দেশ বিভাগোত্তরকালে বাংলা কবিতার দ্বিখণ্ডিত রূপ আমাদের চোখে পড়ে। রাষ্ট্রিক ও ভৌগোলিক পরিবর্তনের ফলে নির্মানের যে শিল্প চাহিদা ও বিষয়নির্ভর সমাজ তা একটি জটিল সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়ায়। এ থেকে পরিত্রাণের যে নির্মোহ যাত্রা, সময়, সমাজ, মানুষ, নগর, অন্তর্দ্বন্দ্ব কবিমানসকেও অস্থিরতার ভেতরে নিয়ে যায়।


শামসুর রাহমানের আবির্ভাব এমন একটি জটিল সন্ধিক্ষণে।


নাগরিকযন্ত্রণা, নিঃসঙ্গতা, দ্রোহ, ঘৃণা, মীমাংসাহীন জটিল সহ-অবস্থান, অবিশ্বাস এসব শামসুর রাহমানের কবিতার প্রধানতম দিক। তাঁর প্রথম পর্যায়ের কবিতার উপজীব্য বিষয় ছিল সম্পূর্ণ মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের সামাজিক অস্থিরতা, বিভ্রান্তি উচ্চাকাক্সক্ষা ও নিঃসঙ্গতাপ্রিয়। দুঃস্বপ্ন ও দ্রোহ থেকে মুক্তিলাভের ঐকান্তিক ইচ্ছা তাঁর কবিতার ভিতর লক্ষ করা যায়।


শামসুর রাহমানের বিস্তৃত কবিতা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা একটি কাব্যভূগোল তৈরি করে দিয়েছে। সেখানে তিনি নিজেকে সমকালীন কবিদের অগ্রযাত্রায় খুলে দিয়েছেন নান্দনিকতার তোরণ। ব্যতিক্রমী কবি হিসেবে নির্মাণ করেছেন নিজস্ব কাব্যভুবন।


শামসুর রাহমান গ্রহণ করেছেন বাঙালির যাপিতজীবনের দূরবর্তী পথ, উৎস, ঐতিহ্য ও অসাম্প্রদায়িক রূপ। তাঁর কবিতাবিষয়ক চিন্তাভাবনা অনেকটাই পাশ্চাত্য ধাঁচের। কবিতার সম্যক মূল্যায়নে সত্যের কালগত বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। অস্তিত্বের সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য কবির সজ্ঞান উৎকণ্ঠা থাকে। তাঁর কবিতা এদেশের মানুষের কাক্সিক্ষত শিল্প যাত্রার সূত্রপাত ও বাঙালির আত্মজিজ্ঞাসাকে চিহ্নিত করে।


‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ (১৯৬০) কাব্যগ্রন্থের ভেতর দিয়ে শামসুর রাহমানের অগ্রযাত্রাকে ক্রমশ কবিতার ভুবনে ভিন্ন শিল্পমাত্রা সংযুক্তি ও পাঠকের চিন্তনকে উসকে দিয়ে নতুন কাব্যধারা নির্মাণ করতে সক্ষম হন। কিংবদন্তি কবি শামসুর রাহমান আর থামেননি। কবিতাকে ঘিরে তিনি যাত্রা করেছেন এক মহাসঙ্কুল পথে। প্রকৃত অর্থে তিনি বাংলা কবিতাকে আধুনিকতায় সংযুক্ত করে প্রবহমান ধারা থেকে কবিতার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহণ করতে সচেষ্ট হলেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থের কবিতার ভেতর জীবনানন্দ দাশ ও বিষ্ণুদের কবিতার সুর অনুরণিত হলেও বহুলাংশে অন্তর্নিহিত। একটি স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণের প্রচেষ্টা তাঁর ভেতরে সফলভাবে কাজ করেছে। পঞ্চাশের প্রান্তবর্তী সময়ের কবি শহীদ কাদরী। যাঁর কবিতায় নাগরিক জীবনবোধের সঙ্গে শিল্পচেতনার সংযুক্তি ঘটেছে। আধুনিক কবিতার সংজ্ঞায়িত রূপকে জীবন-জিজ্ঞাসা ও মননশীলতা চর্চার ক্ষেত্রে আল মাহমুদ ও শহীদ কাদরী একটি বিশিষ্ট কাব্যিক অভিযাত্রায় কবিতার বিশেষ দিককে চিহ্নিত করে।


শামসুর রাহমান পঞ্চাশের দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি-ব্যক্তিত্ব হিসেবে আলাদা একটি জায়গা করে দিয়েছে। তাঁর কবিতায় পাশ্চাত্য মিথ ও গ্রিক পুরাণের ব্যবহার চোখে পড়ে। নিজস্ব ঢঙ, বক্তব্য ও অনুভূতি আর জীবনদর্শনকে ইতিবাচক, শিল্পময় করে তোলার যে ক্ষমতা সেটি তিনি অর্জন করেন অভিজ্ঞতা ও আত্মসনাক্তিকরণের সূত্র ধরেই। পঞ্চাশ দশকের সমাজ ব্যবস্থা, বাঙালির জীবনাবেগ ও মৌলিকত্বের প্রকাশ, নগরমনস্কতা ও জীবনের দৈনন্দিনতার বিচিত্র অনুষঙ্গের মধ্যে বিস্তৃত রূপ লক্ষ করা যায়। সমূহ কারণ থেকেই পঞ্চাশের দশকের কবিদের কবিতায় আধুনিকতার নতুন বাঁক নির্মিত হতে থাকে। শামসুর রাহমান কবিতার নতুন ভূমিতল নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন যা অন্যান্য কবিদের তুলনায় উৎকৃষ্টতার দাবিদার। কবিতার সকল রহস্যময়তাকে তিনি মেলে ধরেছেন পাঠকের সামনে :

ভাবিনি শুধুই পৃথিবীর বহুজলে রেখা এঁকে
চোখের অতল হ্রদের আভায় ধুপছায়া মেখে
গোধূলির রঙে একদিন শেষে খুঁজে নিতে হবে ঘাসের শয্যা।
ছন্দে ও মিলে বানানোর আরক্ত কতো তীক্ষè লজ্জা
দৃষ্টিতে পুষে হাঁটি মানুষের ধূসর মেলায়
… … … … … … …
শিশেরের জলে -স্নান করে মন তুমি কি জানতে
বিবর্ণ বহু দুপুরের রেখা মুছে ফেলে দিয়ে
চলে যাই এই পৃথিবীর কোনো রূপালি প্রান্তে?
নোনা ধরা মৃত ফ্যাকাশে দেয়ালে প্রেত ছায়া দেখে, আসন্ন ভোরে
[প্র. গা. দ্বি. মৃ, আ, রূপালি স্নান]


দ্বিতীয় উদ্ধৃতির মধ্যে জীবনানন্দীয় ঢং, বক্তব্য ও ধ্বনির প্রভাব বিস্তার মনে হলেও শামসুর রাহমানের নিজস্ব স্বর এখানে পরিস্ফুট। প্রথম উদ্ধৃতির ভেতরে প্রেমেন্দ্র মিত্র ও জীবনানন্দীয় ধ্বনি-প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে আসলেও কবিতার ভাষা ও বক্তব্যকে তিনি শাসন করেছেন নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধি দিয়ে। যৌবনের আবেগ, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা এখানে থরথর।

আধুনিক বাংলা কবিতায় শামসুর রাহমানের আবির্ভাবের পর কবিতার একটি ভূ-মণ্ডল পাঠকের সামনে উপস্থিত হয়। অচেতন, অদৃশ্যমান, অসত্য সবকিছু বর্জন করে কবিতায় নতুন ও দৃঢ়তর বন্ধন সূত্র শামসুর রাহমানের কবিতায় আবিষ্কার হতে থাকে :






২. কাল সারারাত ছায়া-অন্ধকার প্রতি পলে পলে
মোমের শিখার মতো ইচ্ছা তার জ্বলেছিলো এই
… … … … … … …
কে যেন তারার মতো কাল রাতে ডেকেছিলো তাকে
মূক ইশারায় দূরে তবু সেই একজন জানি
ভোরতেই চেয়েছিলো উন্মথিত রক্তের ভিতর,
যেমন সে পেতে চায় প্রেমিকের চুমোর আদর
রাত্রির জঠরলগ্না। ছায়াছন্ন অপদেবতার
অমর্ত্য চোখের নিচে রাত তার কাটে হরিণের
করোটির ছবি নিয়ে, সারাক্ষণ জেগে থেকে কাল
শুনেছে ধূসর ধ্বনি অবচেতনার অন্ধকারে।
[প্র. গা. দ্বি. মৃ. আ, তার শয্যার পাশে]


বাস্তব অর্থে শামসুর রাহমানের কবিতা নির্দিষ্ট কোনো এক পথ-পরিক্রমায় আচ্ছন্ন হতে দেখা যায় না; অনিঃশেষ যন্ত্রণায় কখনো কখনো তাঁকে লগ্ন হতে হয় আত্মজিজ্ঞাসার কাছে। উদ্ধৃত কবিতার ভেতর রোমান্টিকতার আত্মবৈভব এবং এর অন্তর্ময় জগৎ আমাদেরকে অনুভূতিপ্রবণ করে তোলে। নিঃসঙ্গতাপ্রিয়, অনুভূতিহীন, আত্মজৈবনিক ও দৈনন্দিন জীবনের লক্ষ্য অর্জনে পৃথিবীর তাবৎ নেতিবাচক বীভৎস পরিম-ল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছেন তিনি। রোমান্টিকতা তাঁর ভেতর প্রগাঢ়ভাবে ভর করে আছে আজও।


সব প্রপঞ্চকে পেছনে ফেলে কবিতার রূপ রস গন্ধ আহরণ এবং নীলিমায় কখনো কখনো তাঁকে সমর্পিত হতে দেখা যায়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ গ্রন্থের মধ্যে পরিশীলিত এক নাগরিক ভুবন এবং এর বিস্তৃত প্রেক্ষাপট পাঠকের সামনে ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকে। ঢাকার নাগরিক কবি হিসেবে তার উত্থান ঘটলেও পরবর্তীকালে পরিবর্তনশীল ঢাকার রূপ বদলে আজ আলাদা এক ঢাকা শহরে পরিণত হয়েছে। বর্তমান ঢাকা শহরের যে চিত্র তা দগ্ধ করে বটে এতো অস্থিরতা, নিঃসঙ্গতা, মায়াহীন চোখের চাহনি পূর্বের দৃশ্যপটে ছিল না। ক্রমশ মানুষের যাপিত জীবন চিত্র হয়ে উঠেছে ভয়াবহ রকমের। যা একজন কবিকে অস্থিরতার ভেতরে নিয়ে যায়। তাঁর ভাবনালোকে ছায়া ফেলে নাগরিক যন্ত্রণার বিচিত্র রূপ। যা শামসুর রাহমানের কবিতার ভেতরেও লক্ষ করা যায়। তাঁর কবিতায় নগরকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য ও উপমার প্রয়োগ অধিক লক্ষণীয়। এবং মাত্রা বৃত্তের পাশাপাশি অক্ষরবৃত্তের প্রবহমানতা প্রথম গ্রন্থের কবিতার ভেতর থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিস্ফুট।
তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রৌদ্র করোটিতে’। নিজস্ব পরিম-ল আর আত্মশনাক্তিকরণের সূত্র ব্যাখ্যা ও অনুসন্ধিৎসু ভাবনালোকে তাঁকে শূন্যতা ও দ্রোহের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। কবিতার প্রকরণগত কাঠামো ও বিনির্মাণ পদ্ধতি শামসুর রাহমানের কবিতার একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছে। নাগরিক আভিজাত্য ও বৈদগ্ধ, নিসর্গ ও নস্টালজিয়ার জগৎ থেকে নিজ ভূখ-ের প্রতি তাঁর যে মমত্ববোধ সেটিকে আত্মমুখী প্রবাহ ¯্রােত বলা হলেও অনিবার্যভাবে জীবনের প্রতিও তাঁর প্রগাঢ় বিস্তৃত পরিসর প্রত্যক্ষ করা যায়। তাঁর এই গ্রন্থের ভেতরে দ্বন্দ্ব বৈচিত্র্যের খেলা চোখে পড়ে। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের উপস্থিতি এখানে পরিলক্ষিত হয়। নৈরাশ্যবোধ আধুনিকতার এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এই গ্রন্থেই তাঁর রাজনৈতিকচেতনা সমৃদ্ধ হতে দেখা যায়। শামসুর রাহমানের কবিতায় আধুনিকতার মূল সুর ও বোধ জাগ্রত হয়েছে।


‘রৌদ্র করোটিতে’ কবিতার প্রথমাংশ এখানে উদ্ধৃত করছি :


জীবনকে তুখোড় ইয়ার ভেবে যদি সারাক্ষণ
মাতলামো করি আর শরীর গাঁজার গন্ধে ভরে
হুট করে চলে যাই সাঙাতের ফুর্তিবাজ রকে,
পাপকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলি হ্রদের আলোর
মতো যদি উৎপীড়িত অন্ধকারে, ঘেয়ো ভিখিরির
ছেঁড়া ন্যাকড়ার ভাঁজে নক্ষত্রের ছায়া দেখি যদি
অথবা স্বপ্নের ঠাণ্ডা হরিণকে কাঁধে নিয়ে,


কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সংগৃহীত উপাদান ও জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা এবং অনুভূতির তীব্র প্রকাশ উপরোক্ত কবিতার বক্তব্য থেকে উপলব্ধি করা যায়।
শামসুর রাহমান বেড়ে উঠেছেন পুরনো ঢাকায়। তখনকার যাপিত জীবনের যে চিত্র তা সহজেই তাঁর বসবাসের অনিবার্যরূপ, জীবনধারা তাঁর কবিতার ভেতর লক্ষণীয়। তাঁর কবিতার তাৎপর্য এভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। ঢাকা শহরের উন্মত্ততা, উচ্ছৃঙ্খলতা, ক্রোধ, ঘৃণা, অবিশ্বাস তাঁকে কবিতা নির্মাণে সহায়তা করেছে ঠিকই কিন্তু ঢাকাইয়া ভাষার কোনো প্রভাত তাঁর কবিতায় নেই বললেই চলে। শামসুর রাহমান বরাবরই অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি। এক দীর্ঘ কবিতার পথ তিনি অতিক্রিম করেছেন। প্রায় চার যুগেরও অধিক সময় ধরে তিনি কবিতার ভেতর মগ্ন হয়ে আছেন। তাঁর সমসাময়িক কবিদের মধ্যে তিনিই এগিয়ে আছেন কবিতা চর্চার মগ্নতায়। শামসুর রাহমান রাজনৈতিক ইঙ্গিতবহ বহু কবিতা লিখেছেন। যা পাঠকের ভেতরে আলাদা একটি জায়গা করে নিয়েছে।


‘স্বাধীনতা তুমি’ তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তাঁর ভেতরে যে অনুভূতি ও আবেগের সঞ্চার করে এবং তাঁর চিন্তার জগতে খেলা করে জিজ্ঞাসা আর আত্মবিস্তার। আকাক্সক্ষার কাছে থিতু হয়ে বসেন তিনি। স্বাধীনতার ইচ্ছাকে তিনি মানুষের ভেতর জাগিয়ে তোলেন এভাবে :


১. স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাক্ড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত স্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
[বন্দী শিবির থেকে, স্বাধীনতা তুমি]

২. তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খ-বদাহন?
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চীৎকার করতে করতে
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটানো যত্রতত্র।
[বন্দী শিবির থেকে, তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা]


এভাবে ক্রমাগত শামসুর রাহমানের কবিতা পর্যালোচনা করলে এক অন্তর্গত বোধের জগতে আমরা প্রবেশ করি। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল তরঙ্গ তাঁকেও আলোড়িত করে একজন যোদ্ধার মতোই। অনুপ্রাণিত করে আমাদের ভেতরে জগৎকে।

বিধ্বস্ত নীলিমা, এক ধরনের অহংকারÑ তাঁর এই গ্রন্থসমূহের ভেতর কবিতার মূল ভিত্তিভূমি তৈরি হতে দেখা যায়। তিনি বাংলাদেশের কবিতার ভূমিকে সুদৃঢ়ভাবে আধুনিক জীবনদর্শন, স্বপ্নযাত্রা এবং সমাজজীবনের সংযোগ, স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের ভেতরে যাত্রাপথ নির্মাণ করেন, যা আমাদের প্রাণিত করে :


নিজের বাড়িতে আমি ভয়ে ভয়ে হাঁটি, পাছে কারো
নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটে। যদি কারো তিরিক্ষি মেজাজ
জ্বলে ওঠে ফস্ করে যথাবিধি, সেই ভয়ে আরো
জড়োসড়ো হয়ে থাকি সারাক্ষণ।
[বিধস্ত নীলিমা, বাড়ি]


একধরনের পলায়ন মনোবৃত্তি এখানে আত্মদর্শন ও ব্যক্তিস্বরূপের কথন সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায়। ব্যক্তিসত্তার বিকাশ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।


‘নিজ বাসভূমে’ কাব্যগ্রন্থের ভেতর কবির অস্তিত্ব, সামাজিক-রাজনৈতিক এবং বসবাসের স্মৃতি নস্টালজিয়ার আনত অনুভব ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।

ভাষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান কবির ভেতরের জগৎ এবং আত্মানুসন্ধানের পথকে বিস্তৃত করে। পথের দূরত্বকে তিনি রাজনৈতিক চেতনা ও অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে চেয়েছেন। তাৎপর্যপূর্ণ ও বন্ধুনমুক্তি (liberty)র বিশ্লেষণ কাব্যভাবনায় অবাধ স্ফুর্তিলাভ ঘটে। যা আমাদের ভাবনাগত মনোজগতেক ছায়া ফেলে। শামসুর রাহমান সমকালীন বাংলাদেশের কবিতার প্যার্টানকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং কাব্যক্ষেত্রে স্বতন্ত্র একটি বৃত্ত নির্মাণ করেছেন। কবিতায় বিভিন্ন মাত্রার প্রয়োগ, শব্দ-সমাবেশ, নতুন সমাজ চেতনা, অস্তিত্বময় সত্যের উন্মোচন, উপলব্ধিজাত বিষয় ভাবনাকে সৃজনক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দিগন্তের সন্ধান লাভ ও শ্রেণিসচেতন জীবন সৃষ্টির অঙ্গীকার শামসুর রাহমানের কবিতার উল্লেখযোগ্য দিক। তাঁর গভীর অবলোকন আত্মদর্শন ও আত্মবিস্তারের তাৎপর্যময় রূপরেখা অঙ্কিত হয় মূল ভূখ-, ভাষা আন্দোলনের রক্তিম চিত্রপট, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত করে।


১. নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।
মমতা নামের প্লুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে।
… … … … … … …
তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?
উনিশ শো বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।
[নিজ বাসভূমে, বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা]


দ্বিধাগ্রস্ত সময়কে কবি অতিক্রম করতে চেয়েছেন। বর্ণমালা, একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য এবং মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ প্রেক্ষাপট তাঁর কবিতায় সফলভাবে উঠে এসেছে। অনুভবের তীব্রতা এখানে লক্ষণীয়। ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি রাষ্ট্রীয়-সামাজিক বিপর্যয়ের একটি পরিণত রূপ।


১. ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভ্যেন্যূর আনাচে-কানাচে

২. আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখ- বস্ত্র মানবিক
আমাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণ পতাকা।


উদ্ধৃত কবিতায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের আলাদা একটি চিত্র নির্মিত হয়েছে। এখানে তাঁর বক্তব্য ঋজু ও স্পষ্ট। প্রবহমান জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই যেখানে সংকটময় সেখানে সকল বৈপরীত্যকে তিনি অনুভব করেন অন্তর্গত চেতনাবোধের মধ্য দিয়ে। নৈঃশব্দের সুনিবিড় ব্যক্তিগত চিন্তান ও বহিরঙ্গের দৃশ্যপট সেটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ইঙ্গিত বহন করে সরাসরিভাবে। বস্তুত রহস্যের ইঙ্গিত, বিনির্মাণের যুগ উপলব্ধি, সংগ্রামী দৃঢ়তা এবং শ্রেণিসচেতন জাগতিক উৎস, দ্বন্দ্বময়, বিরোধী সময় ও সমাজের বিবর্তন তাঁকে প্রবলভাবে আলোড়িত করলেও একটা সূক্ষ্ম অনুসন্ধিৎসু আত্মমগ্নতা তাঁর ভেতরে ভর করে থাকে-


ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, এবার আমি
গোলাপ নেবো।
গুলবাগিচা বিরান বলে, হরহামেশা
ফিরে যাবো,
তা হবে না দিচ্ছি বলে।
ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, এবার আমি
গোলাপ নেবো।
[ফিরিয়ে যাও ঘাতক কাঁটা]


এভাবে ক্রমাগত শামসুর রাহমানের কবিতা পাঠ করলে বোধের জগতে প্রবেশ করে যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করা যায়। কবি মাত্রই নিঃসঙ্গ। নির্মোহ ভাবনা দিয়ে পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্য হনন করতে চান। একজন সফল কবির পক্ষেই সম্ভব শব্দ, বৃত্ত, মাত্রা এবং বিষয়কে কেন্দ্রীভূত করে নির্মাণে তৎপর হওয়া। উপমা ও শব্দের পারস্পরিক সম্পর্ক যেমন শরীর-মন এবং আত্মার। আমাদের সমস্ত ইচ্ছাশক্তি আবর্তিত হতে থাকে দৈনন্দিন যাপিত জীবনের ঘটনাপ্রবাহ থেকে।


ক্ষয় এবং বিষণ্নতা থেকে কবি মুক্তি চান। দৃশ্যমান পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্যকে তিনি খুঁড়ে খুঁড়ে কবিতায় তুলে আনতে চান আবার কখনো কখনো রাজনৈতিক অস্থিরতা তাঁর মধ্যে ক্রিয়া করে। আমাদের নাগরিক জীবনের হতাশা, ব্যর্থতা, অবরুদ্ধ, বেদনাবোধ ও অপ্রাপ্তি অনবরত গ্রাস করছে একথা যেমন ঠিক- বিপরীতভাবে সব সীমাবদ্ধতা ভেঙে ফেলারও প্রয়াস আমাদের ভেতরে কাজ করে। শূন্যতাবোধ আত্মানুসন্ধান, আকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তির দূরত্ব তাঁকেও কখনো কখনো পলায়নবাদী ও পীড়িত হতে দেখা যায়।


শামসুর রাহমানের ভেতরে সৎকাব্যপ্রবণতা লক্ষণীয়। মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্বমুখর মানসিকতাকে তিনি পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেনেনি। মধ্যবিত্তের তাবৎ দুঃখকে তিনি উপড়ে ফেলতে চান। স্বপ্নময় ও মানবিক দৃষ্টিশক্তি দিয়ে এক নতুন ভূখ- তিনি নির্মাণ করতে চান। যার ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান, মধ্যবিত্তের স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার অন্তরায় দিক, শহরের প্রাণহীন চিত্র বাস্তব অভিজ্ঞতা-অর্জিত, মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্ব, দুঃস্বপ্নের ভেতরে স্বপ্নের তীব্রতা তাঁকেও দোদুল্যমানতার ভেতরে নিয়ে যায়।
প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে, ইকারুসের আকাশ, আমি অনাহারী, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ, শূন্যতায় তুমি শোকসভা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের গ্রন্থিত কবিতায় দেখা যায় রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রত্যক্ষ উপস্থিতি আবার অন্যদিকে ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, সংকটময় সত্তা, জিজ্ঞাসা, শূন্য প্রতিধ্বনি।
‘বিপর্যস্ত গোলাপ বাগান’ কবিতাটি মাত্রাবৃত্তে লেখা। রাজনৈতিক ভাবনা থেকে অর্জিত। নাগরিক জীবন যখন পর্যুদস্ত স্বপ্নহীন বিবর্ণ হয়ে ওঠে তখন কবির ভেতরে সবচেয়ে বেশি কাজ করে এর সমগ্রতা। কবিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় দুঃশ্চিন্তা, ঘৃণা, শোক ও যন্ত্রণা :

ক. গোলাপ আমাকে দিয়েছে গোলাপ
বৃষ্টিসিক্ত তামস রাত্রি শেষে।
অথচ বিশ্ব বিষকালো আজ
হিংস্র ছোবলে, ভীষণ ব্যাপক দ্বেষে।


খ. প্রতারিত চোখে দেখি অবিরাম
পথে-প্রান্তরে ছিন্ন মু-ু দোলে।
নিষ্ফল আমি, কী ফল ফলবে
অকালেই গাছ বজ্রদগ্ধ হলে?
[বিপর্যস্ত গোলাপ বাগান]


উদ্ধৃত কবিতাটির অংশবিশেষ পাঠে এর বক্তব্য ও অবস্থান সহজেই অনুমেয় হয়। কবির ভেতরের জগৎ কী রকম ভয়ংকরভাবে রক্তাক্ত ও চৈতন্যলোকে কী রকম বিপর্যস্ত হাওয়া বয়ে গেছে তারই একটি চিত্রকল্প এ কবিতায় চিত্রিত হয়েছে। কবি বৈশ্বিক ও দেশীয় অঘটমান সকল ঘটনাক্রমকে সূক্ষ্মভাবে অবলোকন করেছেন এবং এর একটি মীমাংসাও তিনি খুঁজেছেন বার বার।
‘এখনো দাঁড়িয়ে আছি, এ আমার এক ধরনের অহংকার’- কবির বলিষ্ঠ উচ্চারণ থেকে অনুধাবন করা যায়। তাঁর চিন্তা ও ভাবের প্রকৃতি কী ধরনের। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কবিতার মানকে স্পর্শ করেছে শামসুর রাহমানের কবিতা। সঙ্গতভাবেই তাঁর কবিতা বাঙালির চিন্তন, অনুভূতি, নাগরিক বোধ, আকাক্সক্ষা, আত্মপ্রত্যয় ও আহংকারকে জাগ্রত করেছে। নৈরাশ্যবোধ ও বিস্ময় আধুনিকতার এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আধুনিক মনন বিকাশে শহরের চিত্রিত সমাজ ব্যবস্থা ও জীবনের পদ্ধতিতে আমরা কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরে নিই। এবং এই নগরায়নের ভেতরেই পরাবাস্তবতার সুর ধ্বনিত হয়। শামসুর রাহমানের কবিতার মূল বিষয় ছিল- একদা ঢাকার জীবনচিত্র। মধ্যবিত্তের কাব্য তৃষ্ণাকে ক্রমশ তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন। ‘প্রেম’ অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে তাঁর কবিতায় উপস্থিত হয়েছে;


রঞ্জিতা তোমার নাম এতকাল পরেও কেমন
নির্ভুল মসৃণ মনে পড়ে যায় বেলা-অবেলায়।
রঞ্জিতা, তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো কোনো এক
গ্রীষ্মের দুপুরে দীপ্র কবি-সম্মেলনে
কলকাতায় ন’বছর আগে, মনে পড়ে?
[উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ, রঞ্জিতাকে মনে রেখে]


শামসুর রাহমানের কবিতায় প্রেম, ইতিহাস চেতনা, নগরচেতনা ও অস্তিত্বচেতনার বিস্তার সমানভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। আমাদের কাছে বর্তমানের প্রতিটি মুহূর্তই অস্তিত্বকে ধারণ করে থাকে। কবিতায় ‘ভাব’ এবং ‘শব্দ’ এ দু’টির সংমিশ্রণ ঘটে।


শামসুর রাহমানের কবিতায় অজস্র নতুন শব্দ ও ভাবের তরঙ্গ দোলায়িত হয়েছে। যা পাঠকের চিত্তকে পূর্ণতা দান করে।


কাব্যিক ঐশ্বর্যকে মহিমান্বিত করেছে তাঁর কবিতা। পঞ্চাশের দশকের কবিতাকর্ম অন্যান্য দশকের তুলনায় অনেক বেশি আধুনিক ও চৈতন্যগত। শামসুর রাহমান অখ- সত্তা ও আপন বৈশিষ্ট্যে অনন্য হয়ে উঠেছে একথা যেমন সত্য পাশাপাশি তাঁর ভেতরে বিপরীতমুখী সমাজমানসÑ বলয়ের বিশেষ পরিধি নির্মাণের সৃজন ক্ষমতা পরস্পরবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি করে। সর্বকালেই কবিরা স্ববিরোধীর শিকার হয়েছেন- অস্তিত্বচেতনা থেকে ইতিহাসের ঘটনাক্রম থেকে এবং মানবিকতার বিপর্যয় ঘটলে। জীবনের গভীরতর আবেগ, চিন্তন, অস্তিত্ব ও মানবিক মূল্যবোধ বিপর্যস্ত হলে সর্বাগ্রে কবিকে গ্রাস করে; যেন এ থেকে তার মুক্তি নেই। একজন কবির মূল লক্ষ্য অর্জিত হয় চেতনা, অনুভব ও উপলব্ধির সূক্ষ্মতা বিচারের ওপর। অবশ্য কবিরা কোনো ছকে বাঁধা গ-ির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে চান না; এই না-চাওয়ার প্রাপ্তিটুকুই তার নিজস্ব অর্জিত স্বাধীনতা এবং মানবিক অনুভব। মানব কল্যাণের উৎস হচ্ছে কবিতা। আত্মবিকাশের জন্যও প্রয়োজন স্ব-শিক্ষিত ও অনুশীলনপ্রবণ মানুষ।


জীবন-সমাজ-সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র সম্বন্ধে প্রচ্ছন্ন ধারণা সেটি দেশ ও কালের উপযোগী নতুন মূল্যবোধের জন্য কতোটা সহায়ক ও ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিকতাকে আমরা কীভাবে গ্রহণ করেছি। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও আমরা পাশ্চাত্য ভাবের অনুসারী হয়ে উঠেছি। স্বয়ং শামসুর রাহমানও পাশ্চাত্য সাহিত্যে মগ্ন থেকে কবিতা রচনা করতে চেয়েছেন। ইয়েট্স্-জীবনানন্দ দাশ ও এজরা পাউন্ডের কবিতার প্রতি তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ লক্ষ করা যায়।


আধুনিকতা ও অস্তিত্ব চেতনা কীভাবে নিরূপণ করা সম্ভব কবিতায় সেটা শামসুর রাহমান জীবনোপলব্ধি সামাজিক সহানুভূতি এবং নতুন সৃজন প্রক্রিয়ার উপলব্ধির স্বরূপকে বস্তুময় ও ভাবময় পরিম-লের মধ্য দিয়ে স্বস্তি খুঁজেছেন এবং অস্তিত্ব মানেই যে শূন্যতার এক অপার মহিমা সেটি তাঁর কবিতা পাঠ করলে সহজেই অনুধাবন করা যায়। সুস্থতাই হলো ব্যক্তিসত্তার স্বাধীন বিকাশ। শামসুর রাহমানের ভেতর আমরা এ বিষয়টি লক্ষ করেছি। তাঁর চিন্তার জগৎ মানবতাবাদী জীবনাদর্শে উদ্বুদ্ধ। জীবনের দৈনন্দিন অনুষঙ্গ কীভাবে তাঁর কবিতায় চিত্রিত হয়েছে সেটি দেখা যাক;


১. একটি বিনষ্ট নগরের দিকে চেয়ে থাকা কী যে
শিরাবিদারক মুহূর্তের চাপ সয়ে যাওয়া। রুক্ষ
জনশূন্যতায় পথ ফেলে দীর্ঘশ্বাস ঘন ঘন।
ঘূর্ণমান পুরোনো কাগজ
ল্যাম্পপোস্টের নিচে খুব শীতকাতুরে পাখির মতো
পড়ে আছে, গাছগুলি বিধ্বস্ত পাথুরে মূর্তি যেন
নৈঃশব্দ্যের দীর্ঘ জিভ কেবলি চাটছে বাড়িঘর,
সারি সারি থাম,
যেমন কামুক
তন্ময় লেহন করে মেয়ে মানুষের ঊরু। যে-জীবন করিনি যাপন
তারই ছায়া দুলে ওঠে, দুলে ওঠে মহা ব্যালে। কেন মুছে যায়?
নৈঃসঙ্গ্যে বিলুপ্তিবোধ তীব্র হয়, বড় তীব্র হয়।
[আমি অনাহারী, একটি বিনষ্ট নগরের দিকে]

২. আমাদের বারান্দার ঘরের চৌকাঠে
কড়িকাঠে চেয়ারে টেবিলে আর খাটে
দুঃখ তার লেখে নাম। ছাদের কার্নিশ, খড়খড়ি
ফ্রেমের বার্নিশ আর মেঝের ধুলোয়
দুঃখ তার আঁকে চক খড়ি
[দুঃখ, রৌদ্র করোটিতে]


উদ্বৃত দু’টি কবিতার অংশবিশেষ বিশ্লেষণ করলে একজন কবির কবিতার শিল্পরূপ সমকালীন জীবনবোধ, দৈনন্দিন অনুষঙ্গ ও জীবনের গভীরতার পরিচয় পাওয়া যায়। জীবনানন্দীয় ও ইয়েট্স-এর কবিতার প্রভাব শামসুর রাহমানের কবিতায় পড়লেও পরবর্তী পর্যায়ে শামসুর রাহমান একটা স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণ করতে সক্ষম হন। একজন কবি তাঁর সময়ে আধুনিকমনস্ক হতে চান; কালের বিচারে তার কতোটুকু স্থায়িত্ব লাভ করে সেটি সময়ই বিচার করে দেয়। কবিতা ভাষার বিবর্তন ¯্রােত মুক্ত করতে মধুসূদনের পারঙ্গমতা লক্ষণীয়, তিনি পয়ার ছন্দের অচলায়তন ভেঙে দিয়ে অমিত্রাক্ষর ছন্দের জায়গা করে দিলেন। তদ্রƒপ আমরাও লক্ষ করেছি স্বরবৃত্তকে ভেঙে দিয়ে শামসুর রাহমান অক্ষরবৃত্তে কবিতা লিখতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। শামসুর রাহমানের কবিতার ভাষা-শৈলী বা স্টাইল একটি নিজস্ব ভূ-ম-ল তৈরি করেছে। তাঁর কাব্যভাষার মধ্যে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে। তিনি তাঁর অস্তিত্ব প্রকাশ করেছেন শিল্পের মধ্য দিয়ে। আধুনিক বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ রূপকার শামসুর রাহমান। তিনি অভিনব ভাষায় ও অলংকারে কবিতা নির্মাণ করেছেন। যা শিক্ষিত পাঠকের কাছে অতি আদরণীয় ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। শামসুর রাহমানই প্রথম নাগরিক মধ্যবিত্তকে প্রদর্শন করেছেন বক্তব্য ও শৈল্পিক মহিমায়। ভাষাগত প্রকাশের সবচেয়ে বড় একটি মাধ্যম কবিতা। শামসুর রাহমানের আত্মবিস্তারের অনিবার্যতা রূপায়িত হয়েছে তাঁর কবিতায় এবং তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একজন সফল ও মেধাবী কবিকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। যেমন অপেক্ষা করেছেন জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে। অপেক্ষা করেছেন শামসুর রাহমানও। নিজ প্রচেষ্টায় অভিজ্ঞতালব্ধ যাপিত জীবন থেকে শিল্পের জগতে প্রবেশ করেছেন তিনি। বাংলাদেশের কবিতার একরৈখিক অবয়ব ও আঙ্গিক থেকে শুরু হয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব বক্তব্য কাঠামো এবং অভিজ্ঞতার নতুন স্বর সংযোজন করে এক স্বতন্ত্র কাব্যভুবন নির্মাণ করেছেন তিনি।


‘মাতাল ঋত্বিক’ তাঁর সনেট গ্রন্থ। এক চমৎকার দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে প্রায় প্রতিটি কবিতা। এখানে শব্দ ব্যবহারের তীক্ষèতা ও বক্তব্য ঋজু। মাত্রা বৃত্তের ঢং এখানে পরিলক্ষিত হয়। গ্রন্থের নামকরণেও প্রতিটি কবিতার মধ্যে একটি ভিন্ন প্যার্টান পরিলক্ষিত হয়েছে যা পাঠককে স্বপ্নের ভুবনে পৌঁছে দেবে;


১. পুনরায় জাগরণ, গুল্মঢাকা ঢাকা আমার গুহার
আঁধারে প্রবিষ্ট হলো রশ্মি ঝরনা, জাগালো কম্পন
এমন নিঃসাড় ম্রিয়মাণ সত্তাতটে। যে-চুম্বন
মৃতের পাণ্ডুর ওষ্ঠে আনে উষ্ণ শিহরণ, তার
স্পর্শ যেন পেলাম সহসা এতকাল পরে, আর
তৃণহীন বীতবীজ মৃত্তিকার মদির বর্ষণ
দেখালো শস্যের স্বপ্ন। শিরায় শিরায় সঞ্চরণ
গোলাপেরন, নতুন মুদ্রার মতো খর পূর্ণিমার।
[মাতাল ঋত্বিক, যে-তুমি আমার স্বপ্ন]


২. একটি বাদামী ঘোড়া সঙ্গীহীন অপরাহ্নে এসে
পড়েছে চওড়া পথে শহরের। মাংসের ভিতর
তার জীবনের মর্মমূল
[মাতাল ঋত্বিক, একটি বাদমী ঘোড়া]

৩. কোথায় মনের মুক্তি? বহুদূর জনহীন দ্বীপে
অথবা পর্বতশৃঙ্গে, বিশাল অরণ্যে নাকি ধু-ধু
প্রান্তরের মধ্য পথে?
[মাতাল ঋত্বিক, কোথায় মনের মুক্তি]


‘মাতাল ঋত্বিক’ গ্রন্থের সমগ্র কবিতা পাঠ করলে কবির আধুনিকমনস্ক মনন ও চিন্তনের অসংখ্য উদাহরণ দেয়া সম্ভব। শামসুর রাহমান সফল কবি। এদেশের মানুষের হৃদয় ও ভাবনার কাছাকাছি তিনি নিজেকে পৌঁছে দিয়েছেন।


প্রায় পঞ্চাশটি কাব্যগ্রন্থের জনক শামসুর রাহমান। বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের পর বোধহয় শামসুর রাহমানই কবিতার বিশাল সা¤্রাজ্য তৈরি করেছেন। আজ বাঙালির অহংকার শামসুর রাহমান। কবির জীবনাভিজ্ঞতা, শৈল্পিক সক্রিয়তা ও কাব্যিক অভিযাত্রা জাতীয় জীবনে সম্ভাবনার মন্ত্র দান করে। স্বাধীনতাউত্তরকালে কবিতার ভূমিকে আরও নতুন অভিজ্ঞতায় ঐকান্তিক ও তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলেন শামসুর রাহমান। তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতাসমূহ এ সময় লেখা যা তাঁকে আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য দান করেছে। কবির অবলোকন, আত্মানুসন্ধান, নস্টালজিয়ার দিকে কখনো কখনো তাঁকে তাড়িয়ে ফেরে; আমার বয়স আজ চায়ের কাপে ঠোঁটে সাতচল্লিশটি/চুমো খায়, পদযুগ দেয় মেলে ডাগর সূর্যাস্তে/এক বুক জলে একা দাঁড়িয়ে কখনো দ্যাখে সূর্যোয় আর/কখনো টেবিলে হাত, হাতে ঠেকিয়ে চিবুক/আমার বয়স পড়ে অপরূপ মানচিত্র আকাক্সক্ষার, সুদূর স্বপ্নের/মাঝে-মাঝে বয়সের চোখের পাতায় ক্যাকটাস/বসায় বিষাক্ত দাঁত।


[বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে, আমার বয়স আমি]
শূন্যতা উপচে পড়ে, বুদ হয়ে থাকি, তার বসে থাকা, তার
আসা-যাওয়া পান করে বারবার বড়োবেশি বুঁদ হয়ে যাই;
টলে পড়ে যেতে যেতে আবার সামলে নিই বিব্রত অস্তিত্ব।
[শূন্যতায় তুমি শোকসভা, হ্যাঙওভার]


এভাবে নিজের চেতনা ও সংবেদনশীল শিল্পীচিত্তে প্রাগ্রসর চৈতন্যের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হতে দেখা যায়। একান্ত আত্মগত অনুভূতিলোক উদ্ধৃত দু’টি কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। আধুনিক বাংলা কবিতার মূল ঐতিহ্যধারার সঙ্গে সংযুক্ত থেকে সময়-কাল-দ্বন্দ্ব-দ্রোহ-সমাজ-নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্যকে তিনি ধারণ করেছেন। আধুনিকমনস্ক হৃদয়াবেগ ও মননের সংযোগসূত্রিতা তাঁর কবিতাকে পৌঁছে দিয়েছে জীবনাভিজ্ঞতার মর্মমূলে। তাঁর কবিতার বিষয়, প্রকরণ ও সৃষ্টিবৈচিত্র্য উল্লেখযোগ্য। জীবনের হ্যাঁ-বোধক দিকটিকে কবি উন্মোচন করেছেন ব্যক্তিসত্তার কল্যাণের জন্য। শামসুর রাহমানের অজস্র কবিতার ভেতর জীবনবাদী আদিশক্তির উৎস নির্ণয় করা যায়। এক বর্ণাঢ্য কবিতার ভুবন নির্মাণ করেছেন শামসুর রাহমান।

Scroll to Top