মার্কেসের ছোটগল্প “ত্রামােন্তানা ”


মর্মান্তিক মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তাকে একবার মাত্র দেখেছিলাম বার্সেলোনার জনপ্রিয় বোক্কাসিও ক্লাবে । তখন রাত দু’টো । সুইডিশ যুবকদের একটি দল তাকে কাদাকেস- এ নিয়ে যাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল । ওদের ইচ্ছে ছেলেটি সেখানকার অনুষ্ঠানে অংশ নিক। সুইডিশ্ যুবকরা সংখ্যায় এগারো ।সবারই লম্বা লম্বা সােনালি চুল। যে ছেলেটিকে ধরে ওরা টানাটানি করছিল তার বয়স বড় জোর বছর কুড়ি। মাথায় নীলচে কালাে কোকড়ানাে চুল, সবুজ আভার হলদে জলপাইয়ের মতাে গায়ের রং এবং
ত্বক মসৃণ। ক্যারিবিয়ান এলাকার মায়েরা ছােট থেকেই বাচ্চাদের ছায়ায় হাঁটতে শেখানোর জন্যে তাদের।
এমন গাত্রবর্ণ। আর তাদের চোখজোড়া আরবদের মতাে। সুইডিশ মেয়েদের তা বটেই, এমনী
সুইডিশ ছেলেদেরও অনেককে পাগল করে দেওয়ার জন্যে ওই চোখই যথেষ্ট। ওরা ছেলেটিকে
পানশালার কাউন্টারের ওপর বসিয়ে দেওয়ায় তাকে হরবোলা পুতুলের মতাে দেখাচ্ছিল। হাততালি
দিতে দিতে ওরা জনপ্রিয় গান গাইছিল যাতে গান শুনে মুগ্ধ হয়ে সে রাজি হয়ে যায়। আর আতঙ্কগ্রত্
ছেলেটি বােঝানাের চেষ্টা করছিল কেন সে ওদের সঙ্গে যেতে ইচ্ছুক নয়। এমন সময় কে একজন
সেখানে অনাহূতভাবে ঢুকে পড়ে চিৎকার করে বলতে শুরু করল কেন ছেলেটিকে ছেড়ে দেওয়া উচিত।
একজন সুইডিশ যুবক তেড়ে গেল নবাগতের দিকে। তেড়ে এলেও যুবকটি কিন্তু হাসছিল ; বরং বলা
ভালাে হাসিতে ফেটে পড়ছিল। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে যুবকটি,ও আমাদের। ময়লা ফেলার ড্রাম
থেকে ওকে আমরা তুলে এনেছি।

এইসব ঘটে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আমি সেখানে পৌঁছোেই। দেভিদ
অয়িসূত্রাখের শেষ কনসার্তটি শােনার জন্যে তার আগে আমরা ‘পলৌউ দে লা মুসিকা’-তে ছিলাম।
এখানে এসে দেখি সুইডিশ্রা ছেলেটির কথা কানেই তুলছে না। ছেলেটির আপত্তির কারণ যথেষ্ট
সঙ্গত। সে আদতে কাদাকেসের বাসিন্দা।ওখানকার একটা শৌখিন পানশালা আন্তিলিয়ান গান গাইবার
জন্যে ছেলেটির সঙ্গে চুক্তি করে। ভালােই গাইছিল সে। কিন্তু গতবারের গরমকালে ত্রামােস্তানা অর্থাৎ
উত্তরের ভয়ংকর ঝােড়াে বাতাস শুরু হওয়ার পরেই সে ভয়ে গুটিয়ে যায়। ত্রামােস্তানার দাপটে
পানশালাটি উড়ে গেল। পরের দিনই সে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করে ত্রামােন্তানা শুরু
হােক বা না হােক, আর ফিরে যাবে না কাদাকেসে। ক্যারিবিয়ানদের স্থির বিশ্বাসের মর্ম কি
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার যুক্তিবাদী মানুষের পক্ষে বােঝা সম্ভব? গ্রীষ্মের দাপটে উত্তেজিত এবং কড়া কাতালান
মদের ঘােরে আচ্ছন্ন মানুষের মনে জন্ম নেয় যাবতীয় আদিম ইচ্ছা।

অন্যেরা বােঝেনি তার কথা। আমি কিন্তু বুঝতে পারি। কোস্তা ব্রাভার তীর ধরে গড়ে ওঠা গ্রামগ্ডালির
মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর কাদাকেস। সেখানকার রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাও খব ভালাে। সংকীর্ণ হাইওয়েটর
জন্যেই এটা সম্ভবপর হয়েছে। গভীর খাদের পাশ দিয়ে হাইওয়েটি এমনভাবে এঁকে বেঁকে উঠে গিয়েছে
যে ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল বেগে গাড়ি চালানাে সম্ভব নয়। নেহাত যদি চালাতেই হয় তাে তাকে বায়
স্থির মানুষ হতে হবে। কাদাকেসের পুরােনাে বাড়িগুলির ছাদ খবই নিচ আর সেগুলাের রং সাদা।
ভূমধ্যসাগরের তীরের সব জেলেপাড়াতেই সাবেককালে এমন রীতিতেই বাড়ি তৈরি হত। নতুন বাড়ি
তােরর সময় বিখ্যাত স্থপতিরাও গৃহনির্মাণের এই মৌলিক ও প্রাচীন বৈশিষ্ট্যকে যথার্থ মর্যাদা দেন।
গরমকালে আফ্রিকার মরুপ্রান্তর থেকে তাপ ছড়াতে শুরু করলে এক নারকীয় আড্ডাখানায় পরিণত
হয় কাদাকেস। তিনমাস ধরে ইউরােপের সমস্ত প্রান্ত থেকে আসতে থাকা পর্যটকের ঢল নামে এখানে ।

হাবভাব দেখে মনে হয় তারা যেন স্বর্গ জয় করতে এসেছে। তারপরেই শুরু হয়ে যায় স্থানীয় বাসিন্দাদের
সঙ্গে প্রতিযােগিতা। এমনকী সেই বিদেশিদেরও প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হয় যারা আগে এসে
তুলনামূলকভাবে কম দামে বাড়ি কিনে নিতে পেরেছে। রেষারেষি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছােয় কাদাকেসের
সরচেয়ে আকর্ষণীয় দুই ঋতু বসন্ত ও শরৎকালে। তবে এই সময়েও ত্রামােন্তানার আশঙ্কা থেকে নিস্তার
নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশ্বাস ত্রামােন্তানা হল সেই পরুষ-প্রবল বাতাস যার উৎস স্থলভূমি এবং যা
সঙ্গে করে নিয়ে আসে পাগলামির বীজ। যে সব লেখকেরা এর মর্মোদ্ধারে সমর্থ হয়েছেন তাঁদেরও
এইরকম ধারণা।

বছর পনেরাে আগেকার কথা। ত্রামােন্তানার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকায় তখনও কাদাকেস সম্পর্কে
আমার গভীর আস্থা। কোনও এক রবিবারে দিবানিদ্রার অবসরে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন একটা ঘটনার
পূর্বাভাস পেলাম। মনে হল কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ঝােড়াে বাতাস এসে পৌঁছােনাের আগেই আমার
পঞ্চেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। অবসন্ন বােধ করছিলাম। কেমন যেন বিমর্ষ লাগছিল। আমাদের দুই সন্তান
যাদের বয়স তখনও দশ বছর পেরােয়নি, মনে হচ্ছিল দু’চোখ ভরা বিরূপতা নিয়ে সারা বাড়ি জুড়ে
যেন তারা আমায় অনুসরণ করে চলেছে।
খানিকক্ষণের মধ্যেই যন্ত্রপাতির বাক্স আর সমুদ্রে ব্যবহারােপযােগী দড়িদড়া নিয়ে দারােয়ান এসে
উপস্থিত। দরজা-জানালার নিরাপত্তার যথাযথ বন্দোবস্ত করার জন্যেই তার আগমন। আমার মনমরা
অবস্থা দেখে সে একটুও অবাক না হয়ে বলল,ত্রামােন্তানা আসছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এসে
পড়বে।

এই মানুষটি এক সময় নাবিক ছিল। এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তার পােশাক নাবিকদের মতাে,
বেশি ঝুলের বর্ষাতি জ্যাকেট, টুপি এবং মুখে একটি পাইপ। সাত সাগরের নুন লেগে পােড় খাওয়া
তার গায়ের চামড়া। অবসর সময়ে মানুষটি সেই প্রৌঢ় সৈনিকদের সঙ্গে চত্বরে বসে বােলিং-পিনস্
জুয়াে খেলে যারা একসময়ে অনেক যুদ্ধ করেছে এবং হেরেছে। সমুদ্রতীরের সরাইখানাগুলাের
কোনওটায় বসে সে পর্যটকদের সঙ্গে মদ গেলে। বিশেষত সেই মদ যা খেলে ক্ষিধে বাড়ে। ফৌজি
ভঙ্গির কাতালান ভাষায় কথা বলে সে সবাইকে তার বক্তব্য বােঝাতে সক্ষম। তার একটাই গর্ব,সে
পৃথিবীর সব বন্দর চেনে। তবে স্থলভাগ তার অচেনা। বন্দরবিহীন কোনও শহরই সে চেনে না। এমনকী
প্যারিস, ফ্রান্সও নয়, তা সে যত বিখ্যাত জায়গাই হােক না কেন,এটাই তার কথা বলার ধরন। পাল
তুলে চলে না এমন কোনও যানবাহনে তার এতটুকু ভরসা নেই।

গত কয়েক বছরে হঠাৎ যেন ভীষণভাবে তার বয়স অনেক বেড়ে গেছে। রাস্তার দিকে যাওয়া বন্ধ।
বরাবরের মতাে নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে দিনের বেশিরভাগ সময়ই সে দারােয়ানের ঘরে বসে কাটিয়ে
দেয়। নিজের খাবার নিজেই রেঁধে নেওয়ার জন্যে তার উপকরণ মাত্র একটা সাদামাটা স্টোভ। তবে
ওইটুকুই তার পক্ষে যথেষ্ট যা দিয়ে চমৎকার সব সুখাদ্য রেঁধে সে আমাদের খাওয়ায়।
বাড়ির প্রতিটি তলায় প্রত্যেক ভাড়াটের খোঁজখবর নেওয়া তার রােজ সকালের প্রথম কাজ। এমন
অমায়িক, স্বতঃস্ফূর্ত, উদার এবং অকৃত্রিম হৃদয়ের অধিকারী মানুষ আর একটাও দেখিনি। এটা
কাতালােনিয়ান বৈশিষ্ট্য। এমনিতেই সে খুবই কম কথার মানুষ। নেহাত দরকার হলে সরাসরি বলে
ঠিক সেইটুকুই, যা তার বক্তব্য। হাতে কাজ না থাকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে পূর্বাভাস সংক্রান্ত ছক
কষে। তবে সাধারণত সেগুলি আর ডাকে পাঠানাে হয় না।
সেদিন দুর্যোগের পূর্বাভাস পেয়ে দরজা-জানালার নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে সে ত্রামােন্তানা সম্পর্কে
আমাদের অবহিত করে। তার ভাষ্য অনুসারে ত্রামােন্তানা এক ঘৃণ্য নারী ; অথচ ত্রামােন্তানা ছাড়া তার
জীবন অর্থহীন। আমি তাে রীতিমতাে বিস্মিত। একজন নাবিক কেন স্থল বাতাসকে এত গুরুত্ব দেবে?

তার মতে,এবার হবে আগেরগুলাের মতাে। তার কথা শুনে আমাদের ধারণা হল, দিন বা
মাস মিলিয়ে বছরের হিসেব না করে সে সময়ের গণনা করে কতবার ত্রামােন্তানা এল তার ভিত্তিতে।

গত বছর দ্বিতীয়বার ত্রামােন্তানা শুরু হওয়ার দিনতিনেক বাদে আমার কোলাইটিস হল’,-এমন কথা একবার সে আমায় বলেছিল। হয়তাে সে বলতে চেয়েছিল প্রতিবারের ত্রামােস্তানার হানায় মানুষের
বয়স এক ধাক্কায় বেড়ে যায় বেশ কয়েক বছর। ধারণাটা তার মনে এতই দৃঢ়ভাবে গেঁথে আছে যে
আমাদেরও ত্রামােন্তানা সম্পর্কে কৌতুহল বেড়ে গেল। প্রত্যক্ষ করার ইচ্ছে হল ত্রামােন্তানাকে। কেমন
সেই অতিথি যার এমন সর্বনাশা মােহিনী শক্তি।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। দারায়ান চলে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা শিসের আওয়াজ
কানে এল। ধ্বনিটা ক্রমে তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হয়ে ক্রমশ তীব্র হতে থাকল। শেষে ভূমিকম্পের
গর্জনের মতাে শােনাল। তারপর শুরু হল ঝোেড়াে বাতাস। প্রথমে মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে দমকা
বাতাস। বিরতির ব্যবধান ক্রমশ কমে আসছে। অবশেষে শুরু হল বিরতিবিহীন বাতাসের দাপট। এমন
তীব্রভাবে, নিষ্ঠুরের মতাে বয়ে যাওয়া বাতাসের গতি দেখে মনে হচ্ছে সবটাই অপ্রাকৃত। ক্যারিবিয়ান
এলাকার বাড়িগুলাে সমুদ্রমুখী। পক্ষান্তরে আমাদের বাড়িগুলাের সদর পাহাড়ের দিকে। হয়তাে এটাই
প্রাচীন কাতালােনিয়ানদের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। সমুদ্রকে ভালােবাসলেও সমুদ্র দর্শনের তেমন কোনও গরজ
নেই। তাই ঝােড়াে বাতাস সরাসরি আঘাত করল আমাদের। জানালাগুলােকে শক্ত করে বন্ধ করে রাখার
জন্যে যে সব দড়িদড়াগুলাে বাঁধা হয়েছিল, সেগুলাে ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম।

চারপাশের পরিবেশ তখনও ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। আর তা দেখে আমি তাে রীতিমতাে বিহুল।
আমার মনে হল, এমন সােনালি সূর্য আর অপরাজেয় আকাশ আগে কখনও দেখা যায়নি, ভবিষ্যতেও
দেখা যাবে না। একবার ভাবলাম বাচ্চাদের নিয়ে সমুদ্র দেখে আসি। ওরা তাে মেক্সিকোর ভূমিকম্প
আর ক্যারিবিয়ান সাগরের ঝড়ের মধ্যেই বেড়ে উঠেছে, এরকম এক-আধটা ঝড়ে আর ভয়ের কী আছে।
দারােয়ানের ঘরের পাশ দিয়ে পা টিপে টিপে যাওয়ার সময়ে নজরে এল সে স্থির হয়ে এক দৃষ্টিতে
জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে ঝড়ের দিকে। তার হাতে ধরা রয়েছে এক প্লেট বিন আর সসেজ। সে
আমাদের খেয়াল করেনি।

বাড়ির আড়ালে থাকার জন্যে এতক্ষণ কিছুই বােঝা যায়নি। বাড়ির কোনাটা পার হয়ে খােলা
জায়গায় গিয়ে পড়তেই মনে হল বাতাসের টানে যেন আমরা উড়ে যাব। তাড়াতাড়ি একটা
ল্যাম্পপােস্টকে জড়িয়ে ধরলাম আমরা। ওইভাবেই সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম যতক্ষণ না দারােয়ান
কয়েকজন প্রতিবেশীকে সঙ্গে করে এনে আমাদের উদ্ধার করল। ওই মহাবিপর্যয়ের মধ্যেও নিস্তরঙ্গ
স্বচ্ছ সমুদ্র দেখে আমরা তাে হতবাক। অবশেষে আমরা বুঝতে পারলাম ঈশ্বর অন্য কিছু ইচ্ছা না করা
পর্যন্ত বাড়ির ভিতরেই থাকাটা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।

দু’ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর আমাদের ধারণা হল ওই বাতাস কোনও প্রাকৃতিক ব্যাপার নয়,
আমাদের প্রতি কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশ। কেবল আমাদের উপরই যেন সব ক্ষোভ। দারােয়ান দিনের
মধ্যে বেশ কয়েকবার আমাদের দেখে যায়, খোঁজখবর নেয়। আমাদের মানসিক অবস্থা নিয়ে সে যথেষ্ট
চিন্তিত। আমাদের কাছে আসার সময় তার হাতে থাকে কিছু মরশুমি ফল আর বাচ্চাদের জন্যে ক্যান্ডি।
খরগােশের মাংস আর শামুক দিয়ে পরিপাটি মধ্যাহ্নভােজ হল মঙ্গলবার। এটা কাতালোেনিয়ান
রন্ধনপ্রণালীর অন্যতম সেরা অবদান। রান্নাঘরের একটা ছোট্ট টিনের পাত্রে করে সে এটা রেঁধেছে।
আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় এ এক মহাভােজ।

বুধবার কোনও কিছু ঘটেনি। তবে ঝােড়াে বাতাস তখনও উদ্দাম। ওই দিনটি আমার জীবনের
দীর্ঘতম দিন। এ যেন সকাল হবার আগেকার অন্ধকার। মাঝরাতের পর সকলে একসঙ্গে জেগে গেলাম।
চারদিকের নিঃসীম নীরবতায় আমরা অভিভূত। শুধু মৃত্যুর সঙ্গেই এই নিস্তব্ধতার তুলনা করা যেতে
পারে। পাহাড়ের দিকের গাছগুলাের একটা পাতাও নড়ছে না। তখনও দারােয়ানের ঘরে আলাে জ্বলেনি।
আমরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। প্রাণভরে উপভােগ করলাম ভাের হওয়ার আগেকার আকাশ, উজ্জ্বল
তারাদের এবং ঢেউয়ের চূড়ায় ফসফরাসের আলাে চমকানাে সমুদ্রকে। ঘড়িতে তখনও পাঁচটা বাজেনি।
শেষ পর্যন্ত পরিত্রাণ পাওয়া গেছে এই আনন্দে পর্যটকদের অনেকে পাথর ছড়ানাে বালুকাবেলায় ভিড়
জমিয়েছে। কয়েকদিন শাস্তিভােগের পর পালতােলা নৌকোগুলাের পাল-মাস্তুল-দড়িদড়া ঠিকঠাক করা
হচ্ছে।
বাড়ি থেকে বেরােনাের সময় দারােয়ানের ঘরে আলাে না জ্বলার বিষয়টাকে গুরু্ব দিইনি। ফিরে
আসার সময় সমুদ্রের মতাে বাতাসেও ছড়িয়ে পড়ছে ফসফরাসের ঝিকিমিকি। কিন্তু দারোয়ানের ঘরটা
অঙ্ধকার। ব্যাপারটা ভালাে ঠেকল না। দরজায় বার দুই টোকা দিলাম। কোনও উত্তর নেই। এবার দরজা
ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। আমার বিশ্বাস, ছেলেরাই প্রথমে তাকে দেখতে পায়। ওদের ভয়ার্ত চিৎকার
কানে এল।নাবিকের পােশাক পরিহিত বৃদ্ধ দারােয়ানটি যার জ্যাকেটের কলারে বিশিষ্ট নাবিকের তকমা
আঁটা, ঘরের মাঝখানে বরগা থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে। ত্রামােস্তানার দমকা হাওয়ায় তখনও তার
শরীরটা দুলছে।
আমাদের ছুটির তখনও অর্ধেক বাকি। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই আর কখনও ফিরে না আসার
প্রতিজ্ঞা করে আমরা চলে এলাম কাদাকেস ছেড়ে। যদিও আমরা নিশ্চিতভাবে জানতাম যে ফিরে আসার
টান বরাবরের জন্যেই থেকে যাবে আমাদের মনে। পর্যটকেরা তখন আবার বেরিয়ে পড়েছে। প্রাক্তন
সৈন্যদের চত্বরে গান বাজছে। তবে অভিজ্ঞ প্রৌড়দের আর বােলিং-পিনস্ খেলায় উৎসাহ নেই।
মার্তিনিস্ পানশালার ধুলােমাখা জানালা দিয়ে এক ঝলক নজর করতেই চোখে পড়ল বেশ কয়েকজন
ভাগ্যবান বন্ধুকে, যারা বেঁচে গেছে এবং সেই উজ্জ্বল ত্রামােন্তানার বসন্তে নতুন করে জীবন ফিরে
পেয়েছে। এসব বহুদিন আগেকার কথা।
এইজন্যেই বােক্কাসিও ক্লাবে সকাল হওয়ার আগেকার সেই বিষন্ন সময়ে আমিই একমাত্র বুঝতে
পেরেছিলাম কী সেই আতঙ্ক যার জন্যে কাদাকেসে ফিরে যেতে ছেলেটির এত আপত্তি। সে
নিশ্চিতভাবে জানত,তাহলে সে মরবে। কিন্তু সুইডিশদের নিরস্ত করার কোনও উপায় নেই। তারা
ছেলেটিকে টানতে টানতে নিয়ে চলল। ওদের ইউরােপীয় মানসিকতা থেকে ওরা ধরে নিয়েছে যে
গায়ের জোরে আফ্রিকার কুসংস্কার থেকে ছেলেটিকে মুক্ত করবে। তবে ওদের সঙ্গীসাথিদের মধ্যে
মতভেদ রয়েছে। কেউ বাহবা দিচ্ছে আবার কেউ বিদ্রুপ করছে। এমন অবস্থার মধ্যেই ওরা ছেলেটিকে
ভ্যানে চড়িয়ে দিল। আপত্তি জানিয়ে সে ক্রমাগত পা ছুঁড়ছে। কাদাকেসের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার জন্যে
একদল মাতাল ভর্তি সেই ভ্যানটা রওনা দিল।
পরের দিন সকালে টেলিফোনের ঘণ্টাধ্বনিতে ঘুম ভাঙল। রাতের পানভােজন থেকে ফিরে এসে
জানালার পর্দা টেনে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। কটা বাজে জানি না। তবে গরমকালের ঝকঝকে আলােয়
শােবার ঘরটা ঝলমল করছে। ফোনে ভেসে এল অপরিচিত কিন্তু উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর। ‘কাল রাতে যে
ছেলেটাকে ওরা কাদাকেসে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, মনে পড়ছে?
আর কিছুই শােনার দরকার নেই। শুধু ওই কথাটি ছাড়া যা ঘটেছে আমার দুর্ভাবনা এবং কল্পনার
চেয়েও তা অনেক বেশি মর্মান্তিক। কাদাকেসের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার একটু আগে বুদ্ধিভ্রংশ
সুইডিশ যুবকদের মুহূর্তের অসতর্কতার সুযােগে ভীত-সন্ত্রস্ত ছেলেটি অপ্রতিরােধ্য মৃত্যুর হাত থেকে
বাঁচার চেষ্টায় চলন্ত গাড়ির থেকে লাফিয়ে পড়েছে গভীর খাদের মধ্যে।

(জানুয়ারি ১৯৮২)
মূল শিরােনাম : Tramontana

Scroll to Top