গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের গল্প : সুপ্ত সুন্দরী ও বিমান

ভাষান্তর: অমিতাভ রায়

সুন্দরী এবং স্মার্ট। কোমল ত্বকের রং রুটির মতাে। কাঁচা আলামন্দ্ বাদামের মতাে সবুজ চোখের মণি।কাধের ওপর এলিয়ে পড়েছে দীঘল-কাজল-অবিন্যস্ত অলকদাম। তাকে ঘিরে ইন্দোনেশিয়া বা আন্দিজ পর্বতমালা এলাকার মধ্যযুগের পরিবেশের মতাে একটা বিশেষ পরিস্থিতি গড়ে উঠেছে। মার্জিত রুচির পােশাক। লিঙ্কস্-এর চামড়ার লােমশ জ্যাকেট। র-সিঙ্কের জামাটায় হালকা ফুলের নকশা ছাপা আর সাদা-মাটা লিনেনের ট্রাউজার্স। জুতােয় বোগেনভিলা ফুলের রঙের চিকন ডােরা দাগ। ‘আমার দেখা  সেরা সুন্দরী।’ প্যারিসের ‘শার্ল দ্য গল’ এয়ারপাের্টে নিউ ইয়র্কের প্লেন ধরার জন্য চেক-ইন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় আমার পাশ দিয়ে সে শান্ত-ঋজু-দীর্ঘ পদক্ষেপে চলে যাচ্ছিল। আর আমি এইসব ভাবছিলাম। তার উপস্থিতি এমন এক অতি-প্রাকৃত অনুভূতি যা ক্ষণেকের জন্য অস্তিত্ব অনুভবের সুযােগ দিয়ে এয়ারপাের্টের টার্মিনালের জনারণ্যে মিলিয়ে গেল।

তখন সকাল নটা। সারা রাত ধরে বরফ পড়েছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা বেশি বলে মনে হচ্ছে। কারণ, বরফের জন্য ধীরগতিতে গাড়ি চলছে। এমনকী হাই-ওয়েতেও ধীর গতি।ট্রাকগুলাে হাই-ওয়ের ওপর একটার ঘাড়ে আরেকটা চেপে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এয়ারপাের্টের টার্মিনালের ভেতরে তখনও বসন্তকাল।

এক ওলন্দাজ বৃদ্ধা ঘণ্টাখানেক ধরে তাঁর এগারােটা সুটকেশের ওজন নিয়ে তর্কাতর্কি করছিলেন। তাঁর পিছনে আমি বিরক্ত হতে শুরু করার মুহূর্তে কেমন যেন একটা আবেশে আচ্ছন্ন করে দিল তার ক্ষণেকের উপস্থিতি। সুতরাং তর্কটা কীভাবে মিটল, আমার জানাই হল না। কাউন্টারে বসে থাকা টিকিট-ক্লার্ক মেয়েটার মিষ্টি ধমকে সংবিত ফিরল। ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আমতা আমতা করে মেয়েটাকে প্রশ্ন করলাম,-সে প্রথম দর্শনের প্রেমে বিশ্বাস করে কিনা। মেয়েটি বলল,-নিশ্চয়ই। অন্য কোনও রকম প্রেম? অসম্ভব। একই সাথে কম্পিউটারের পর্দায় চোখ রেখে সে আমায় সিট পছন্দ করতে বলল।ধূমপানবর্জিত এলাকা অথবা সিগারেট খাওয়া যায়,কোন ধরনের সিট আমার পছন্দ সেটাই তার জিজ্ঞাস্য। এটা কোনও ব্যাপারই নয়’,-আলতাে করে কথাটা ছুঁড়ে দিয়েই বেশ দৃঢ়ভাবে নিবেদন করলাম,শুধু ওই এগারােটা স্যুটকেশের পাশে নয়। 

পেশাদারি হাসিতে তর্কের আসল বিষয়টার স্বীকৃতি প্রকাশ করলেও পর্দা থেকে কিন্তু তার চোখ সরল না।

 একটা নম্বর বেছে নিন’,সে আমায় বলল। ‘তিন, চার আর সাত খালি আছে।

‘চার।’

তার মুখে জয়ের হাসির ঝিলিক দেখা গেল।

‘গত পনেরাে বছর ধরে এখানে কাজ করছি’,সে বলে চলল। ‘আপনিই প্রথম যিনি সাত নম্বর

বাছলেন না।’

বােডিং পাস-এ চার নম্বর লিখে সব কাগজপত্র সে ফেরত দিয়ে দিল। এই প্রথম সে আমার দিকে আভুর রঙে রাঙানাে চোখে তাকাল। পুনরায় সুন্দরীর দেখা না পাওয়া পর্যন্ত এটাই ছিল আমার একমাত্র সান্ত্বনা । ঠিক তখনই সে বলল,- ‘এয়ারপাের্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং সব প্লেনই দেরিতে ছাড়বে।’

’কতক্ষণ?’

‘ভগবান জানেন’,এক গাল হাসি ঝরিয়ে সে বলল। ‘আজ সকালে রেডিও ঘােষণা করেছে যে এটা বছরের তীব্রতম তুষার ঝড়।’

মেয়েটা ভুল বলেছিল। এটা শতাব্দীর ভয়ংকরতম তুষার ঝড়। কিন্তু প্রথম শ্রেণীর প্রতীক্ষালয়ে তখন পুরোপুরি বসন্ত । ফুলদানিতে সাজানাে গােলাপগুলাে সম্পূর্ণ সতেজ। অ্যামপ্লিফায়ারে ভেসে আসা 

যন্ত্রসংগীতের মুর্ছনা এতই মধুর আর আবেশাচ্ছন্ন লাগছে যে মনে হচ্ছে সংগীত-স্রষ্টরা ঠিক এমনি

চেয়েছিলেন। হঠাৎই আমার মনে হল সুন্দরীর জন্য এটাই তাে যথার্থ জায়গা। প্রতীক্ষালয়ের অন্যান্য 

প্রান্তে অত্যন্ত দৃঢ়তা নিয়ে তার খোঁজ শুরু করলাম। কিন্তু বেশিরভাগই নিত্যদিনের সেই সব মানুষ যারা ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ে আর যাদের বউয়েরা ভাবে অন্য কারও কথা। কাচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে বরফে ঢাকা প্লেন গুলো । বিস্তীর্ণ এলাকা মনে হচ্ছে তুষার তৈরির কারখানা ।  ‘রজি’-র দিগন্ত ছোঁয়া মাঠগুলােকে দেখে মনে হচ্ছে-এক শঙ্কিত-সন্ত্রন্ত সিংহের দাপটে চতুর্দিক বিপর্যস্ত। দুপর হওয়ার আগেই প্রতীক্ষালয়ের বসার জায়গা ফুরিয়ে গেল। আর গরম এত বেড়ে গেল যে খােলা হাওয়ার খোঁজে আমায় পালিয়ে যেতে হল।

বাইরে এসেই চোখে পড়ল এক সাংঘাতিক দৃশ্য। সবরকমের মানুষের ভিড়। প্রতীক্ষালয়গুলাে ভর্তি। দম বন্ধ করা করিডরগুলােয় পর্যন্ত মানুষ ঠাঁই নিয়েছে। এমনকী সিড়িগুলােতেও মানুষ তাদের পােষা জীব-জন্তু, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ভিড় জমিয়েছে। শহরের সঙ্গে যােগাযােগ-সংযােগ ব্যাহত। ঝড়ে থমকে যাওয়া এক মহাকাশযানের মতাে মনে হচ্ছে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের তৈরি প্রাসাদটাকে। আমি কিছুতেই ভাবতে পারছি না এমন সাদামাটা সুবিশাল জনতার মধ্যে সে থাকতে পারে। তবে কল্পনাই আমাকে অপেক্ষা করার বাড়তি সাহস জুগিয়ে উদ্দীপ্ত করে রাখছিল। দুপুরের আগেই টের পেলাম এক জলমগ্ন জাহাজের যাত্রীতে পরিণত হয়েছি আমরা। সাতটা রেস্তোরাঁ, এক রাশ ক্যাফেটারিয়া, ফাস্টফুডের দোকানগুলােয় মানুষের সীমাহীন লাইন ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই সেগুলাের ঝাপ ফেলে দিতে বাধ্য করল। আসলে খাবারদাবার সবই ফুরিয়ে গেছে। বাচ্চাগুলাে,যাদের মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবীর শিশুদের সমাবেশ, সব একসঙ্গে কান্না জুড়ে দিল। আটকে যাওয়া সমস্ত যাত্রী হঠাৎ যেন এক যূথবদ্ধ জনতায় পরিণত। এ সময় এটাই তাে স্বাভাবিক। খাদ্যান্বেষণে বেরিয়ে বাচ্চাদের একটা দোকানে দু’ কাপ ভ্যানিলা আইসক্রিম পেলাম। খদ্দেররা চলে যাওয়ায় দোকানের কর্মচারীরা টেবিলের ওপর চেয়ারগুলাে তুলে দিচ্ছিল। আমি তখন আস্তে আস্তে আইসক্রিম খাচ্ছিলাম। আইসক্রিম শেষ হবার মুখে এক হাতে আইসক্রিমের কাপ আরেক হাতে চামচ নিয়ে দোকানের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে আবার মনে পড়ল সুন্দরীর কথা।

নিউ ইয়র্কের প্লেনটা সকাল এগারােটার বদলে অবশেষে ছাড়ল পরের দিন ভাের চারটেয় প্লেনের ভেতরে গিয়ে দেখি প্রথম শ্রেণীর অন্য যাত্রীরা নিজের জায়গায় বসে গেছে। বিমান সহায়কদের একজন আমায় নির্ধারিত আসনে বসিয়ে দিল। আমার তাে দম বন্ধ হয়ে যাবার মতাে অবস্থা। পাশের সিটটা,মানে জানালার ধারেরটা, সুন্দরী দক্ষ যাত্রীর নিপুণতায় গুছিয়ে নিচ্ছে। আমার মনে হল,এ কথাটা লিখলে, কেউ কোনওদিন বিশ্বাস করবে না। আমতা আমতা করে কোনওরকমে সুন্দরীকে শুভেচ্ছা জানালাম। এবং সে তা শুনতে পেল না।

এমনভাবে সাজিয়েগুছিয়ে সে বসছে যেন এখানে বহুদিন বসবাস করতে হবে। আদর্শ বাড়ির মতাে প্রতিটি জিনিস নাগালের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করে, অর্থাৎ নির্ধারিত জায়গায় ঠিক ঠিক জিনিসটা রেখে সে শেষ করল আসন গােছানাে। এর মধ্যে প্লেনে আমাদের স্বাগত জানাবার জন্য শ্যাম্পেন উপস্থিত। তার জন্য একটা গেলাস তুলে নিয়ে ভাবলাম,একটু অপেক্ষা করাই ভালাে। কারণ, সুন্দরী প্রথমে দুর্বোধ্য ফরাসিতে এবং পরে অন্তত কিছুটা সড়গড় ইংরেজিতে এক গেলাস জল চেয়ে বিমান সহায়ককে জানিয়ে দিল যে কোনও অবস্থাতেই পুরাে বিমানযাত্রায় যেন তার ঘুম না ভাঙানাে হয়। তার কাঝালোে নির্দেশকে প্রাচ্যদেশীয় ঘণ্টার শােক-ধ্বনির মতাে মনে হল।

জল আসার পর সুন্দরী একটা প্রসাধন-বাক্স কোলের ওপর রাখল। বাক্সটার কোণাগুলােয় ঠাকুমার আমলের ট্যাঙ্কের মতো তামার তাপ্পি লাগানো । বাক্সটা খুলে সুন্দরী দুটো সোনালী রঙের ট্যাবলেট বের করল । বাক্সটার মধ্যে রয়েছে অন্যান্য রঙেরও ট্যাবলেট । সুন্দরী নিয়ম মেনে, সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে, সুষ্ঠুভাবে  এমন ভঙ্গিতে একের পর এক সব কাজ করে গেল যে মনে হয় জন্মের পর থেকে তাকে পরিকল্পনাহীন কোনও ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়নি। অবশেষে জানালার ধাতব পর্দাটা টেনে নামিয়ে সিটের হেলান দেওয়ার গদিটাকে যতটা সম্ভব পেছনে হেলিয়ে দিয়ে, কম্বলে নিজেকে জড়িয়ে সুন্দরী আমার দিকে পেছন ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল। তবে সে জুতাে খােলেনি, আর চোখে ঠুলি পরে নিয়েছে।একদমে, একবারও না থেমে, এতগুলা কাজ সে পর পর করে গেল। নিউ ইয়র্ক যেতে সময় লাগে আট ঘণ্টা। তবে আমাদের আরও বারা মিনিট বাড়তি লাগল। এই শাশ্বত সময়ে একবারের জন্যেওতার দীর্ঘশ্বাস শােনা গেল না, অথবা তার বসার ভঙ্গিতে এতটুকুও পরিবর্তন ঘটল না।

এ এক দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ সফর। প্রকৃতিতে সুন্দরী মেয়েদের চেয়ে আর কিছু সুন্দর নেই, এটাই আমার বরাবরের বিশ্বাস। গল্পের বই থেকে উঠে আসা চরিত্রটা, যে এখন আমার পাশে অঘােরে

ঘমােচ্ছে, তার থেকে এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে সরিয়ে রাখা আমার পক্ষে যেন একেবারে অসম্ভব।

প্লেন চলতে শুরু করার পর আগেকার সহায়কের বদলে উপস্থিত নতুন একজন কার্তেজীয় সহায়ক।

নতুন সহায়ক সাবান-ক্রিম-টুথপেস্টের প্যাকেট আর গান শােনার ইয়ার ফোন দেবার জন্য সুন্দরীর

ঘুম ভাঙাতে উদ্যত হল। আমি তাকে সুন্দরীর দেওয়া নির্দেশটা জানালাম। কিন্তু সে সুন্দরীর ওষ্ঠাধরের স্পন্দন থেকে উচ্চারিত উত্তর শুনতে আগ্রহী। এবং সে শুনল,-সুন্দরীর খাবারও দরকার নেই। সহায়ক সব কিছু ভালাে করে শুনে নিয়ে শান্ত স্বরে বিরক্তি প্রকাশ করে বলল যে, সুন্দরীটি নিজের গলায় ‘বিরক্ত কোরাে না লিখে লম্বা ছােট্ট একটা কার্ড ঝুলিয়ে রাখলেই ভালাে করত।

একা একাই খেলাম। সে জেগে থাকলে তাকে যা যা বলতাম, তা পুরােপুরি মনে মনে আউড়ে

গেলাম। তার ঘুম এতই গভীর এবং সুস্থির যে একসময় আমার মনে হল সম্ভবত ঘুমের ওষুধের বদলে

সে খেয়েছে মৃত্যুর ওষুধ। প্রতিবার পানি করার সময় তার সঙ্গে মনে মনে সুরা-শুভেচ্ছা বিনিময় করতে করতে বলছিলাম,-সুন্দরী, তােমার স্বাস্থ্য কামনা করি ।’

খাওয়াদাওয়ার পর আলােটা কমিয়ে দেওয়া হল। শুরু হল একটা সিনেমা। কিন্তু দেখবে কে?

অন্ধকারের জগতে আমরা দু’জন তখন একাকী। শতাব্দীর সবচেয়ে সাংঘাতিক ঝড় থেমে গেছে। রাতের আঁধারে তারা ভরা আকাশে, সুবিশাল আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হল প্লেনটা যেন একেবারেই গতিহীন। কয়েকঘণ্টা ধরে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। জলের ওপর ছড়িয়ে পড়া মেঘের ছায়ার মতাে তার কপালের ওপর ভেসে বেড়ানাে স্বপ্নের ছবি দেখেই কেবল প্রাণের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল। গলার চিকন সােনালি হারটা তার সােনালি চামড়ার মধ্যে প্রায় মিলিয়েই গেছে।তার নিখুঁত কান দুটো বিধানাে হয়নি। গােলাপি নখণগুলাে সুস্বাস্থ্যের পরিচায়ক। আর বাঁ হাতে একটা সাধারণ আংটি। বছর বিশেকের বেশি তার বয়স মনে হচ্ছে না ধরে নিয়ে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম যে ওটা বিয়ের আংটি নয়,-কোনও সাময়িক বাগদানের চিহ্ন মাত্র। শ্যাম্পনের ফেনার চরমনেশায় ভাসতে ভাসতে আমি জেরার্দো দিয়েগাের সেই বিখ্যাত এবং বিশ্বাসযােগ্য সনেটটা স্তোত্রের মতাে আউড়ে যাচ্ছিলাম।

 ‘তুমি নিদ্রাচ্ছন্ন জানতে পারায়,

নিশ্চিন্ত নিরাপত্তায়,

ক্ষমা করার বিশ্বস্ত ধারাবাহিকতায়,

বিশুদ্ধ সুত্রে,

আমার শৃঙ্খলাবদ্ধ হাত দু’টি দিলাম সঁপে তােমায়।’

তারপর আমার সিটটাকে তার সিটের সমান করে হেলিয়ে দিলাম। মনে হচ্ছে, ফুলশয্যার বিছানায়

সৌন্দর্যেরই সুগদ্ধ। অসহনীয় অবস্থা। গত বসন্তে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার লেখা একটা উপন্যাস।

যতটা নিবিড়ভাবে আমরা শুতে পারতাম তার চেয়েও কাছাকাছি, পাশাপাশি আমরা এখন শুয়ে আমি,তার শ্বাসপ্রশ্বাস আর গলার ওঠানামা একই সুরে ছন্দোবদ্ধ। ত্বক থেকে ভেসে আসা সুবাস যেন তার সৌন্দর্যেরই সুগন্ধ । অসহনীয় অবস্থা । গত বসন্তে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার লেখা একটা উপন্যাস পড়েছিলাম । প্রাচীন জাপানের কিয়ােতাে শহরের বড়লােকদের নিয়ে উপন্যাস। একই বিছানায় শহরের সুন্দরী মেয়েদের নগ্ন ও মাতাল অবস্থার উন্মাদনা দেখার জন্য রাতের পর রাত বড়লােকেরা প্রচুর খরচ করত। ওরা মেয়েগুলাের সঙ্গে বিছানায় যেত বিরক্তি নিয়ে। তবে ওরা মেয়েদের ছুঁত না, নেশা কাটাত না, ঘুম ভাঙাত না, এমনকী তাদের বিরক্তও করা হত না। আসলে তাদের ওই রকমভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেই বড়লােকেরা আনন্দের উপকরণ খুঁজে পেত। সেই রাতে সুন্দরীকে ওইভাবে ঘুমােতে দেখতে দেখতে প্রাচীন জাপানি ধনীদের বিচিত্র আনন্দ তাে অনুভব করলামই, উপরস্তু সেই আনন্দ নিজেও পুরােপুরি উপভােগ করলাম।

 ‘কে ভেবেছিল আমি এক প্রাচীন জাপানি পুরুষে পরিণত হব’-বিড়বিড় করতে করতে বললাম।আসলে এ সবই শ্যাম্পেনের প্রতিক্রিয়া।

মনে হয়, শ্যাম্পেনের দাপটে এবং সিনেমার নিঃশব্দ বিস্ফোরণের ফলে আমি ঘণ্টা কয়েক ঘুমিয়ে নিয়েছি। ঘুম ভাঙার পর মাথাটা যন্ত্রণায় ছিড়ে যাচ্ছিল। বাথরুমে গেলাম। দু’টো সিটের পেছনে সেই এগারােটা স্যুটকেশের মালকিন বৃদ্ধা বিচিত্র ভঙ্গিতে যুদ্ধক্ষেত্রের বেওয়ারিশ মৃতদেহের মতাে বসেছিলেন। রঙিন পুঁতির মালার সঙ্গে আটকানাে তাঁর চশমাটা পড়ে রয়েছে মেঝেতে। একটু মানসিক তৃপ্তি পাবার জন্য চশমাটা তুললাম না।

শ্যাম্পেনের উদ্দাম নেশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর নিজেকে দেখলাম আয়নায়। একেবারে শ্রদ্ধার অযােগ্য একটা চেহারা নজরে এল। ভালােবাসার বিপর্যয় যে এত ভয়াবহ হতে পারে ভেবেই শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। প্লেনটা কোনও ছুঁশিয়ারি বার্তা না দিয়েই হঠাৎ করে নিচে নেমে এল। তারপরই আবার সােজা হয়ে ছুটে চলল পূর্ণ গতিতে। জ্বলে উঠল ‘নিজের জায়গায় ফিরে আসুন লেখা আলােকিত সংকেতটা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের সিটের দিকে এই আশায় পা চালালাম যে ঈশ্বর সৃষ্ট প্লেনের টালমাটাল অবস্থা সুন্দরীর ঘুম ভাঙিয়ে দিতে পারে। আতঙ্ক দূর করার জন্য সে হয়তাে আমার দুবাহুতে আশ্রয় চাইতে পারে। তাড়াহুড়ােয় ওলন্দাজ ভদ্রমহিলার চশমাটা মাড়িয়ে দিয়ে প্রায় ভেঙেই ফেলছিলাম! ভাঙলে হয়তাে আনন্দ পেতাম। আমার আগেই চার নম্বর সিটটা বেছে না নেওয়ার জন্য হঠাৎ একটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মানসিকতা আমার মধ্যে জেগে উঠল। চশমাটা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে সন্তর্পণে ফেলে দিলাম তাঁর কোলে।

সুন্দরীর নিদ্রা নিরবচ্ছিন্ন। প্লেনটা স্থির হলে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তার ঘুম ভাঙানাের প্রবল ইচ্ছেটা দমন করতে হল। সফরের শেষ ঘণ্টাটা তাকে জেগে থাকা অবস্থায় দেখতে চাইছিলাম। এমনকী সে খেপে গিয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করলেও এই বাসনাটার বাস্তবায়নে আমি রাজি ছিলাম। কারণ তা হলে আমার স্বাধীনতা, হয়তাে বা আমার যৌবনকেও পুনরুদ্ধার করতে পারতাম। গভীর আক্ষেপের সঙ্গে মনে মনে বললাম,চুলােয় যাক, কেন যে মরতে ষাঁড় হয়ে জন্মালাম না।’

প্লেন থেকে অবতরণের সংকেত বার্তা লেখা আলােগুলাে জ্বলে উঠতেই সে ঘুম থেকে উঠে পড়ল।তাকে এত সুন্দর আর তরতাজা লাগছে যে মনে হল সে এতক্ষণ গােলাপের বাগানে ঘুমােচ্ছিল। তখন আমি বুঝলাম পাশাপাশি বসা যাত্রীরা ঘুম ভাঙার পর কেন পুরােনাে দম্পতিদের মতাে সুপ্রভাত’ বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করে না। এবং সে-ও করল না। চোখের ঠুলিটা খুলে ফেলল। ঝকঝকে চোখদুটো মেলে তাকাল। সােজা করল হেলানাে সিটটাকে। কম্বলটা গুছিয়ে সরিয়ে রাখল। চুলের গােছটা নিজের ভারেই এক পাশে এলিয়ে পড়েছিল। একবার মাথাটা ঝাকিয়েই সেটা ঠিক করে ফেলল। প্রসাধন বাক্সটা খুলে রাখল কোলের ওপর। চট করে শুরু করল প্রয়ােজনীয় প্রসাধন। এই কাজটায় সে অনেকখানি সময় নিল। প্লেনের দরজা না খােলা পর্যন্ত চলল প্রসাধন পর্ব। মনে হচ্ছে পাশে বসে থাকা মানুষটা তার নজরেই আসেনি। লিঙ্কস্-এর লােমশ চামড়ার জ্যাকেটটা গায়ে চড়াল। আমাকে ডিঙিয়ে চলে যাবার সময় লাতিন আমেরিকান স্প্যানিশ ভাষায় চলতি টানে ‘ক্ষমা করবেন উচ্চারণ করল। শুভ বিদায় বা ধন্যবাদ বলল না। আমাদের যৌথ সফরটা সুখকর করে তালার জন্য আমি যা যা করেছি, নিদেনপক্ষে সেই কারণেও একটা ধন্যবাদ না জানিয়েই নিউ ইয়র্কের রৌদ্রস্নাত আমাজন জঙ্গলে মিলিয়ে গেল সুন্দরী।

(জুন, ১৯৮২)

মূল শিরোনাম:: El avión de la bella durmiente

অনূদিত গল্পটি অনুবাদকের অনুমতি সাপেক্ষে দ্বে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত তাঁর বই “ গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস্ গল্পসমগ্র থেকে গ্রহণ করা হয়েছে ।
Scroll to Top