রবীন্দ্রনাথ একবার সিভিলিয়ান হতে চেয়েছিলেন

এই নিবন্ধের শিরোনাম দেখে আমাদের চিরাচরিত কবির মূর্তিটি কেমন অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনে হতেই পারে এমনটি আবার হয় নাকি? একদম ঠিক। কিন্তু ইতিহাস যে অন্য কথা বলে। ফিরে যাওয়া যাক্ সেই ইতিহাসের পাতায়….

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিন মাস হিমালয়ভ্রমণ শেষে বালক রবি আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করলেন। এদিকে মহর্ষির কাছে গোটা তিন মাস যেভাবে তিনি শিক্ষালাভ করেছিলেন, ফিরে বেঙ্গল অ্যাকাদেমিতে তা না পেয়ে আবার স্কুলে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ল। এবং আগের তুলনায় আরো কঠিন হয়ে উঠল। তাই নানা অজুহাত, নানা ছুতো আর ছলনায় তিনি আবার স্কুল থেকে পালানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। এদিকে পিতার সঙ্গে হিমালয়-প্রত্যাগত জোড়াসাঁকো বাড়ির ছোটো ছেলেটি সকলের কাছে খুব মূল্যবান হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তা বলে তাঁর স্কুল পালানোর ভূমিকাকে কেউই সুনজরে দেখেননি। যেমন এই প্রসঙ্গে বড়োদিদি সৌদামিনি দেবীর কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছিলেন,

‘একদিন বড়দিদি কহিলেন, “আমরা সকলেই আশা করিয়াছিলাম বড়ো হইলে রবি মানুষের মতো হইবে কিন্তু তাহার আশাই সকলের চেয়ে নষ্ট হইয়া গেল”।’

১৮৭৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেঙ্গল অ্যাকাদেমি পর্বের পাঠ তাঁর সমাপ্ত হলে অভিভাবকরা তাঁকে সেন্ট জেভিয়ার্সে ভর্তি করিয়ে দিলেন ১৮৭৪ সালে। এদিকে শুধু তো বড়দিদি নন, দাদারাও হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁদের এই আদরের ভাইয়ের লেখাপড়া আর ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ‘জীবনস্মৃতি’র পাতায় সেকথা জানালেন,

‘আমি বেশ বুঝিতাম, ভদ্রসমাজের বাজারে আমার দর কমিয়া যাইতেছে।’

এই আত্মগ্লানির কারণ উল্লেখ করলেন,

‘দাদারা মাঝে মাঝে এক-আধবার চেষ্টা করিয়া আমার আশা একেবারে ত্যাগ করিলেন। আমাকে ভর্ৎসনা করাও ছাড়িয়া দিলেন।’

এদিকে ‘ছেলেবেলা’য় জানা যায় তিনি বলেছিলেন,

‘আমাদের বংশে তখন ধন ছিল না কিন্তু নাম ছিল, তাই রীতিটা টিকে গিয়েছিল।’ কোন্ রীতির কথা বলেছিলেন? আসলে ‘পাস-করা ভদ্রলোকের ছাঁচে ছেলেদের ঢালাই করা’র রীতিটা ঠাকুরবাড়িতে ছিল না। আর তাই ‘লেখাপড়ার গরজটা ছিল ঢিলে।’

ততদিনে তাঁর কবিতা জনমানসে বেশ একটা আলোড়ন তুলেছে। সার্কুলার রোডের পার্সিবাগানে হিন্দুমেলার নবম বার্ষিক অধিবেশনে সর্বসাধারণের সামনে স্বরচিত কবিতা ‘হিন্দুমেলার উপহার’ আবৃত্তি করে খ্যাতিও অর্জন করেন। সেন্ট জেভিয়ার্সে তখন ‘ফিফথ ইয়ারস ক্লাসে’ পড়েন তিনি, যা কিনা নবম শ্রেণীর সমতুল্য। মাত্র আড়াই মাস পড়েন সেখানে। এই স্কুলের পরিবেশের সঙ্গেও মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হলেন। সেই ‘জীবনস্মৃতি’র পাতায় লিখলেন,

‘যে-বিদ্যালয় চারিদিকের জীবন ও সৌন্দর্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন জেলখানা ও হাঁসপাতাল-জাতীয় একটা নির্মম বিভীষিকা, তাহার নিত্য-আবর্তিত ঘানির সঙ্গে কোনোমতেই আপনাকে জুড়িতে পারিলাম না।’

মায়ের মৃত্যু ঘটে এই সময়ে এবং কাদম্বরী দেবীর স্নেহচ্ছায়ায় পথচলা শুরু হয়। দু বছরের উপর বিদ্যালয় যাওয়া নেই, ইতিমধ্যে অভিভাবকরাও তাঁকে নিয়ে চিন্তা করাও ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু কি হবে তাঁর ভবিষ্যৎ? শুধু তো কবিতা লিখলে চলবে না, ফলে মেজ-দাদা একটা পরিকল্পনা করলেন। দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ছোটোভাইয়ের বিষয়ে পরামর্শে বসলেন। মহর্ষিকে প্রস্তাব দিলেন, রবিকে তিনি ইংলণ্ডে নিয়ে যেতে চান। দেবেন্দ্রনাথ বুঝলেন এ প্রস্তাব অতি উত্তম।

বিলেত যাওয়া পাকা হতে লাগল। এদিকে এই তাঁর জীবনের এই সপ্তদশ বছরে উল্লেখযোগ্য ঘটনার একটি হল ‘ভারতী’ পত্রিকার প্রকাশ।এদিকে জোড়াসাঁকোর অন্দরমহলে যেমন বাহিরমহলেও রবির বিলেত যাত্রা নিয়ে সকলের মনেই প্রস্তুতি চলছে।দেখতে দেখতে ১৮৭৮ সাল এল। রবীন্দ্রনাথ সেইসময়কার মনের অবস্থা লিখলেন সেই ‘জীবনস্মৃতি’র পাতাতেই…

‘ভারতী যখন দ্বিতীয় বছরে পড়িল [ অর্থাৎ বৈশাখ ১২৮৫ -তে ] মেজদাদা প্রস্তাব করিলেন, আমাকে তিনি বিলাতে লইয়া যাইবেন। পিতৃদেব যখন সম্মতি দিলেন তখন আমার ভাগ্যবিধাতার এই আর-একটি অযাচিত বদান্যতায় আমি বিস্মিত হইয়া উঠিলাম।’

এ যেন যতবার আলো জ্বালাতে চান তিনি নিভে যায় বারেবারে। তা বিলেত যাবেন কেন তিনি? কবি নিজেই এর উত্তর দিয়েছেন,

‘কথা ছিল, পড়াশোনা করিব, ব্যারিস্টর হইয়া দেশে ফিরিব।’

কিন্তু তিনি কি সত্যি সত্যিই ব্যারিস্টর হতে গিয়েছিলেন? নাকি ব্যারিস্টর হয়ে ফিরেছিলেন? কি বলে ইতিহাস! দেখা যাক….

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্টেট আর্কাইভসের ১৮৭৮ সালের ৪ নং ফাইলের প্রচ্ছদে স্পষ্ট করে লেখা..

‘General Department/Miscellaneous Branch/Proceedings for March 1878/ Number of Proceedings/ 1-2/ Subject/ Application from Rabindranath Tagore praying for a certificate of his age for the Indian Civil Service Examination/ Date of Proceedings/ 13-3-78’

কি দরখাস্ত করেছিলেন সতেরো বছরের রবীন্দ্রনাথ? নিজের স্বাক্ষরিত সেই দরখাস্তে লিখেছিলেন,

To

The Secretary to the Government of Bengal

Sir,

As I intend to proceed to England for the purpose of competing at the Indian Civil Service Examination I beg to request the favor of your granting me a certificate of my age as required by the Rules. I beg to submit my Horoscope in evidence of my age and to express my readiness to appear at the time & place which you may be pleased to appoint to prove the same.

I have the honor to be

Calcutta Sir,

The [12]th March 1878. Your obedient servant

Rabindranath Tagore

এই চিঠিটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নদিদি’র জামাই জানকীনাথ ঘোষাল তৎকালীন বেঙ্গল গভর্মেন্টের অ্যাসিস্টান্ট সেক্রেটারি রাজেন্দ্রনাথ মিত্রকে অনুরোধ করে লেখেন ‘We shall feel greatly obliged to you by your forwarding them to the [police] today with instructions to expedite the matter. এই অনুরোধ কার্যকর হয় এবং ৬৯ নং ফাইলে একটি নোট লিখে ফাইলসহ সমস্ত কাগজপত্র পুলিশ কমিশনারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মার্চের তেরো তারিখেই। পরে ২০ মার্চ ফোর্ট উইলিয়ম থেকে বেঙ্গল গভর্মেন্টের জেনারেল ডিপার্টমেন্টের সচিব ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য রবীন্দ্রনাথের বয়সের প্রমাণপত্র অনুমোদন করেন।

Certificate of the date of the birth

Of Baboo Robindra Nath Tagore proceeding to England.

I HEREBY certify that Baboo Robindra Nath Tagore a candidate

for admission to compete for Indian Civil Service, has admitted

the proofs of his birth to the Magistrate of the Calcutta district, and

has satisfied that officer that he was born about the date stated by him, viz

6th May 1861 ( One thousand Eight hundred and Sixty one ).

তাহলে কি ধরে নেওয়া যেতে পারে রবীন্দ্রনাথও মেজদাদার মতো সিভিলিয়ন হতেই চেয়েছিলেন! এরপর তিনি নিশ্চিন্তে সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে আমেদাবাদ যাত্রা করেন। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,

‘শিকড়সুদ্ধু আমাকে উপড়ে নিয়ে আসা হল এক খেত থেকে আর-এক খেতে। নতুন আবহাওয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া শুরু হল।’

Scroll to Top