রাত্রির শেষ প্রহরে একমাত্র বরযাত্রীর হর্ষ

নাইট শো দেখে বেরিয়ে রিকশা খোঁজার সময় ইবনে বতুতা আমাকে আবিষ্কার করে ফেলল,  কিংবা  বলা যায় আমিই  তাকে আবিষ্কার করলাম।
    তার পরণে ঝিলিক ঝিলিক পাঞ্জাবি, ট্রাউজারের বদলে জিন্স।   পায়ে মখমলের নয়া নাগরা। তার এই নয়ার মধ্যে যে ষোলআনা  রহস্য লুকিয়ে আছে তা বুঝতে দেরি হলো না, তাকে কিছু বুঝতে না – দিয়ে আমাকে নিয়ে খেলার সুযোগ করে দিলাম তাকে । বড়শি গিলে  আমার স্কন্ধে হাত রেখে  ‘সুইট হ্যাভেন মিষ্টান্ন ভান্ডারের’ দিকে হাঁটতে লাগল । আমি একবারও তার দিকে না- তাকিয়ে অগ্রসর হলাম ।
      ‘আইসো এক প্রস্থ ফরজ কার্য এই বেলা সারিয়া ফেলি।’  আহা কী ভাষা!
     মিষ্টান্ন ভান্ডারে ঢুকে  সে পাঁচ সের চমচমের অর্ডার দিল। এখন থেকে রহস্যের দানা গলতে শুরু করবে বলে প্রত্যয় হলো আমার।  কী আশ্চর্য তখনও খেয়াল করিনি তার হাতে খয়েরি  রঙের লেদারের গুডিগুডি একটি   স্যুটকেস , মাঝারি সাইজের।

‘ এই হাঁড়িটা  ধরো একটু ।’
    সে-ও  ছাড়বার পাত্র নয়। সমানে সমানে খেলবে, ভাঙবে তবু মচকাবে না। রিকশাওয়ালাকে শহরতলীর একটা গন্তব্যের কথা বলে আমাকে একটা সিগারেট অফার করল – তুলতুলে তুলোওয়ালা ‘ডানহিল’। এখন সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ড , মিষ্টি সুরভী ছড়ালেও নেশার আমেজটা ঠিক আনতে পারল না। ফলে একটা ‘স্টার’ ধরিয়ে ফুকতে লাগলাম আমি । বললাম, ‘ এইবার তোমার সফর অনেক দীর্ঘ ছিল, কোন্ কোন্ নগরে গেলে, কী কী দেখলে বয়ান কর?’
    ‘এতদিন পরে দেখা, এই তোমার জানবার বিষয়,এই  তোমার কৌতূহল ? অবাক না – হয়ে পারি না।’
     খানিক বাদে একটা জিন্নাহ ক্যাপ মাথায় পরল সে । দু ধরনের টুপিতে আমার এলার্জি   হয় – জিন্নাহ ক্যাপ ও লিয়াকত ক্যাপ। এ কথা সে-ও জানে। আমি অতর্কিতে তার টুপিটা খুলে নিয়ে খাদে নিক্ষেপ করলাম।
      হা হা করে উঠল ইবনে বতুতা। রিকশাওয়ালাকে দিয়ে হার্ডব্রেক করালো। জিন্নাহ ক্যাপ খাদে না- পড়ে রাস্তার কিনারায় পড়েছিল বলে দিয়াশালাই জ্বালাতেই পেয়ে গেল। কপট রাগে ফেটে পড়ে বলল,’ তোমাকে বোঝা ভার, এই টুপির কী দোষ?’
     টুপির দোষগুণ বিচারে না-গিয়ে বললাম,  ‘যদিও এশার ওয়াক্ত  অতিক্রান্ত হয় নাই, ৯সে ক্ষেত্রে যথাস্থানে গিয়ে টুপি পরলেই হতো।’
     সে বলল, ‘নামাজ ছাড়াও টুপির অন্যবিধ  ব্যবহার আছে। অধৈর্য হয়ো না, শিঘ্র দেখতে পাবে।’
      বুঝলাম খেলার শুরু ও শেষ আসন্ন।
    একটা বাড়ির সামনে রিকশা থামাল। বিজলি বাতির আলোয় ঝলমল করছে। কলা গাছ আর দেবদারু পাতায় সাজানো গেট। নানা রঙের কাগজের ঝালর আঁটা। গেট থেকে যে-রাস্তাটা ঢুকে গেছে ভেতর বাড়ি অবধি তার দুপাশে নিশান দিয়ে সাজানো। গেটের ওপরে বড় করে লেখা ‘ ওয়েল কাম’ ।
    আমার খুব চেনা এ বাড়ি। কিন্তু এ বাড়িতে তো বিয়ের যুগ্গি  একটা-ই মেয়ে, তার নাম পেয়ারা বানু। আমাদের সকল কাজের গুরু নজিবুর রহমানের একমাত্র বোন। কিন্তু ইবনে বতুতার সঙ্গে কি এরা এই  মেয়ের বিয়ে দেবে? অসম্ভব।  
    কজন লোক এগিয়ে এল আমাদের দেখে। একজন বলল,  ‘আর বরযাত্রীরা কোথায়?’
     ইবনে বতুতা বলল,’ আর নেই।’
  ‘ কী বলেন ? মাত্র একজনকে নিয়ে বিয়ে করতে এসেছেন ?’
     বতুতা নীরব।
   ‘ ঠিক আছে একটু অপেক্ষা করুন। নিয়মটা সারি।’
      তারা চলে গেলে বললাম,’ আমাকে আগে জানালে পারতে। এ শহরে তোমার -আমার ইয়ার – বন্ধুর অভাব নেই।’
   ‘ ইচ্ছে করেই বলিনি। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হওয়ার বিস্তর সম্ভাবনা।’
    এই হচ্ছে ইবনে বতুতা।  তার এ- নামটা  আমিই দিয়েছি। সে বলেছিল,’ এত বড় মানুষটাকে অপমান করলে? কোথায় তিনি, কোথায় আমি। মূর্খ বলে কি তাঁকে চিনি না? বিশ্ব বিখ্যাত এই পরিব্রাজকের আসল নাম  আবু আবদুল্লাহ্ মুহাম্মদ। মরক্কো দেশে জন্ম তাঁর।  বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। ১৩৪৬ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম আগমনের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশে তাঁর সফরের সূচনা। হযরত শাহজালাল আউলিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষ করে  আগস্ট মাসে সোনারগাঁও গিয়েছিলেন। সেখান থেকে জাভার উদ্দেশে রওয়ানা  দেন। ঠিক কিনা?’
     ‘ঠিক না হয়ে যায়? তোমার সঙ্গে তাঁর অনেক মিলের কারণে ওই নাম দিয়েছি। তোমারও দুটি নাম – আমিন হাসান ও হাসান আমিনুল হক। তাঁর মতো তুমিও  বিস্তর ভ্রমণ করে থাকো। যাহোক, এ সব নিয়ে আলাপের উপযুক্ত সময় এটা নয়। ওই দেখ তোমাকে বরণ করার জন্যে রমণীকূল বরণডালা হাতে এগিয়ে আসছেন। তাদের উপযুক্ত সম্মানী প্রদানের জন্যে প্রস্তুত হও।’
    ‘এ – বাবদে আমার কর্তব্য কিছু নাই। সামান্য নগদ অর্থ এখানে আছে। তা দিয়ে রমণীকূলকে সন্তুষ্ট কর।’
    তারা নগদে একশ টাকা ভিন্ন বর ও তার সঙ্গে আগত ব্যক্তিকে ভিতরে প্রবেশের ব্যবস্থা করতে অস্বীকার করলে আমার সঙ্গে তুমুল বিতণ্ডা বেঁধে যায়। আমি জীবনে বহু বার এ- ধরনের কাজে জড়িয়েছি ও সাফল্য লাভ করেছি।ফলে গেট আগলে দাঁড়ান রমণী ও বালিকারা অচিরেই হার মানল।
     ভেতরে ঢোকার পর বাঁধল আর এক বিপত্তি। কন্যার পিতা জীবিত নেই। বড়ভাই  লিগ্যাল গার্জিয়ান । তিনি এ- বিয়েতে রাজি নন বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। তাকে ছাড়া কাজী সাহেব বিয়ে পড়াবেন না। বতুতা ঘামতে লাগল। বলল,  ‘কাজী তোমার বিশেষ পরিচিত। তাকে সামলাও।’
   কাজী  সাহেব আমার বাবার বন্ধু। আমাদের বাড়িতে যাতায়াত আছে। এগিয়ে গেলাম। বললেন, ‘ এ বিয়েতে গোলমালের সম্ভাবনা। ভাইকে ছাড়া পরানো যাবেনা। তাকে নিয়ে এস।’
    কন্যার এক আত্মীয় বলল,  ‘তিনি কোথায় আমি জানি। তার কাছে যাওয়ার সাহস কারও নেই। আপনার তো ঘনিষ্ঠ। একবার যদি চেষ্টা করে দেখেন।’
  অন্দরমহল থেকে সংবাদ এল বিয়ের কণে আপনাকে ডাকছে। আমি প্রমাদ গুনলাম। পেয়ারা বানু আমার হাত ধরে কেঁদে ফেলল, ‘ একমাত্র আপনার কথাতেই ভাই আসবেন ।’
   ‘কিন্তু হাসানের সঙ্গে তুমি কী করে জড়ালে? কতটা চেন তাকে?’
  ‘ আপনার এই কথার জবাব আমি  দেব। আগে ভাইকে হাজির করেন।’
    গোটা অন্দরমহলে তখন  কান্নার রোল।
    আমি আত্মীয় ছেলেটাকে বললাম,’ শিগগির নিয়ে চল আমাকে।’
     যদিও জানতাম, নজিবুর ভাইকে ম্যানেজ করা সহজ কাজ নয়। তার মতো ঘাউরা ও বগরাগী  মানুষ এ তল্লাটে দুটি নেই।
    একটা আরামকেদারায় শুয়ে লম্বা নলওয়ালা হুকো টানছিলেন গুড়গুড় করে। চোখ বন্ধ। আমার অস্তিত্ব টের পেয়ে হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার তুমি এইখানে?’
     ‘ না, আপনার একমাত্র বোনের বিয়ে, আর আপনি অন্য বাড়িতে বসে। তাকে কতটা স্নেহাদর করেন তাতো আমি…’
  ‘ ওই মিয়া, আমার বইনের বিয়ার খরব তুমি পাইলা কেমনে, আমি কি দাওয়াত দিছি তুমারে?’
    ‘ না,আমি বরপক্ষ।’
    তিনি লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তখন হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । টিনের চালে বৃষ্টির অবিরাম হল্লা। বজ্রপাতের ভয়ঙ্কর শব্দে আমি চমকে চমকে উঠতে লাগলাম ।
  ‘ ওই টাউটটার সঙ্গে তোমার কী সম্বন্ধ? শালা আস্তো একটা বাটপার।’
   ‘সে আমার বন্ধু।’
    ‘সে তোমার বন্ধু হয় ক্যামন কইরা? তুমিও  কি বাটপারি শুরু করচাও নাকি, না এ – ধরনের কোনো অভিযোগ তো আমার কানে আসে নাই ?’
    আমি স্তম্ভিত ও বাকরুদ্ধ। এই পর্যায়ে এসে তিনি ক্ষমা দিলেন । আরাম কেদারায় পুনরাসন গ্রহণ করে আমার হাতে একটা ‘বগলা’ সিগারেট গুঁজে দিয়ে বললেন,’ ‘ধরাও।’   কিংস্টর্কে দীর্ঘ টান দিয়ে তার একটা হাতটা  ধরি,’ আমি এখানে এসেছি পেয়ারা বানুর কথা ভেবে। আপনার মতো আমিও তাকে স্নেহ করি…’
   তিনি কিছুক্ষণ নীরবে হুকোয় গুড়গুড় আওয়াজ তুলে আমার দিকে তাকালেন।
    ‘ওই একটা কারণেই আমি বাটপারটাকে এখনও শ্যূট করি নাই।’
   তিনি আবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বিড়বিড় করে বললেন,’ লও  যাই,   রাইত ম্যালা  হইচে।’
    অত:পর সবকিছু ঠিকঠাক সমাধা হলো।  খাওয়ার সময় তিনি পোলাও- কোর্মা, ফিরনি- জর্দার  সব ডিশ আমার সামনে  হাজির করে বললেন,’ বরযাত্রী আসবার কথা তিরিশ জন, তাদের জন্যে যে – খাবারের এন্তেজাম করা হয়েছে তার সবটুকু তোমাকে  এখন একাই খাইতে হবে। কোনো উপায় নাই ।’
    অথচ এই ভদ্রলোকের সঙ্গে বহুবার পাত পেতে খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার আছে। আমি কতটুকু খেতে পারি না পারি তার বিলক্ষণ জানা। আর তিনি যে এই শহরের একজন মশহুর খানেওয়ালা তা-ও  কারও অজানা নয়।
   এ কথায় হাজিরানে মজলিশে হাসির রোল উঠল। কাজী সাহেব বললেন,’ নজিবুর এই বেলা তাকে ক্ষমা করে দাও। আসবার পর থেকে তাকে বিস্তর দৌড় – ঝাঁপ করতে দেখেছি ।’
   তিনি একবসায় গোটা চারেক রোস্ট, বড় একবাটি খাশির রেজালা এবং অর্ধ হাড়ি মিষ্টি দধি সাবাড় করে ঢেকুর তুলে বললেন, ‘যাও তুমার কর্ম আমিই সমাধা কইরা দিলাম।’
   কন্যা – বিদায়ের ক্ষণে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হলো। পাঁচ ভাইয়ের এক বোন।  রাজকুমারের বদলে এক ঘুটে কুড়োনির  ছেলের গলায় মালা পরিয়েছে সে সকলের অমতে, ভালোবেসে। বোনকে বনবাসে পাঠাচ্ছে বলে চিৎকার করে কাঁদছে পাঁচ ভাই। কাঁদছে বোনও, চিৎকার করে নয় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। নজিবুর ভাই বোনকে কোলে করে এনে  রিকশায় বরের  পাশে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যত্নে রাখিস আমার বইনেরে। যদি উল্টাপাল্টা কিছু কানে আসে তরে কিন্তু জবো কইরা ফালামু।’
    এই দেশি পরিব্রাজক ও ভবঘুরে তার নবপরিণীতা বধূকে নিয়ে কোথায় তার বাসর শয্যা রচনা করবে সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা না – থাকায় আমি তার কানে কানে বললাম, ‘এবার কোথায়?’
    সে কিছু বলল না। পেয়ারা বানু ফিসফিস করে বলল,’ রিজু আপার বাসায়।’ ও বাড়িও আমার চেনা।  ওদের খালাতো বোন। এখান থেকে বেশি দূরে নয়।
    নয়া জামাই – বউয়ের রিকশার পেছনে আমার জন্যে একটা রিকশা দাঁড় করানো ছিল। নজিবুর ভাইয়ের বদান্যতায় একমাত্র বরযাত্রীর  সম্মানেই যে এ – আয়োজন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
    ইবনে বতুতার মাথায় তখনও জিন্নাহ ক্যাপ আর  মুখে রুমাল দেখে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল  আমার ।

   
       শালা সঙ সেজে বসে আছে।

   আমি পেয়ারা বানুকে বললাম, ‘ টুপি  আর রুমালটা সরিয়ে নাও তো, অসহ্য ।’ সে মুচকি হেসে বলল,  ‘আমার পক্ষে সম্ভব নয় দাদাভাই।’
   আমি রাগে গর্জাতে গর্জাতে তার  টুপি খুলে নিলাম, সরিয়ে নিলাম রুমাল। ইবনে বতুতা বলল, ‘ শিগগির একটা সিগারেট দাও আমাকে। নেশায় পেট ফুলে গেছে আমার।’
     আমি নিজে একটা  ‘বগলা’  ধরিয়ে লম্বা এক  টান দিতেই চিৎকার ভেসে এলো কানে – হল্ট । দুটো রিকশাই  থেমে গেল । চারজনের একটা দল। কাঁধে থ্রি- নট- থ্রি রাইফেল। এদের গায়ে নকশাল বাড়ির হাওয়া। সশস্ত্র রাজনীতির ধারায় শামিল হয়েছে। আমার- ই বন্ধু বান্ধব । রাত বিরোতে দেখা হলে ওদের দলে যোগ দিতে অনুরোধ করে। আমি কোনো রকমে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। ওদের মত ও পথে একবারেই   আস্থা নেই আমার।
   ‘কী ব্যাপার এত রাতে?’
  ‘আমার এক বন্ধুর বিয়ে হলো…’
   ‘কোন্ বন্ধু?’
    ‘তোরা চিনবিনে।’
    ‘চিনবো না মানে? নাম কি?’
       ‘হাসান আমিনুল হক।’
     ‘কোন্ হাসান আমিনুল? ওই যে টাউট- ভবঘুরেটা?’
    আমি প্রমাদ গুনলাম। ওদের রিকশাটা এত কাছে যে নিশ্চিত শুনতে পেয়েছে। আমি কথা ঘোরাবার জন্যে বললাম,’ সিগারেট চলবে তোদের ?’
   ‘দে।’
    আমি পুরো প্যাকেট  একজনের হাতে দিয়ে বললাম,  ‘আজ যাই তাহলে, বড্ড ক্লান্ত রে । তোরা সাবধানে যাস।’
    ‘ঠিক আছে। আমাদের একটা লিফলেট নিয়ে যা, পড়িস।’
     ওরা চলে যাওয়ার পর আমার  আবার সিগারেট তেষ্টা পেল । সেই  ‘ডানহিল’- মেয়েলি টাইপের কোমল সিগারেট। আমার ঠিক পোষায় না। আমার চাই  ‘স্টার’ কিংবা ‘বগলা’, একেবারে কড়া ধাঁচের।
    একটু পরেই আবার হল্ট – ধ্বনি ভেসে এলো। লোকাল পুলিশের টহল দল। এরাও আমার চেনা।
    ‘কী ব্যাপার ভাই এত রাতে কুথা থিকা?’
     ‘আমার এক বন্ধুর বিয়ে ছিল।’
     ‘ও তাই নাকি? আমরা দাওয়াত পাইলাম না যে।’
      ‘হঠাৎ করে হলো তো। না হলে পেতেন।নেন সিগারেট নেন।’
     একজন বলল, ‘বাহ্ , ডানহিল। অনেক দিন খাই না। দেন দেন আমারে একটা দেন।’
      এদেরকেও পুরো প্যাকেট দিয়ে  দিলাম। গঙ্গা কি মাল, দরিয়া মে ঢাল।
       এ বাড়িতে  ঢুকতেই টের পেলাম নানান্ পদের ফুলের মিলিত  ঘ্রাণে মউ – মউ করছে বাসরঘর । এ বাড়ির সামনেই  বিরাট ফুলের বাগান। দুলাভাই বললেন, ‘এইটুকুন পথ আসতে এত দেরি  হলো যে?’
     আমি বললাম,’ দু বার ধরা খেতে হয়েছে – প্রথমবার সর্বহারাদের কাছে। দ্বিতীয় বার পুলিশের কাছে ।’
     ‘বল কি। প্রবলেম হয়নি তো?’
       ‘নাহ্।’
      বাসরঘরে  ঢুকতে ইবনে বতুতাকে কিঞ্চিৎ ঘাটগচ্চা দিতে হলো পাড়ার  রাত-জাগা মেয়ে আর  ওই বাড়ির  শালীদের তৎপরতায়। আমাকে তো ঢুকতেই দিল না। একজন বলল,’ আজকের রাত  শুধু এই সঙটার জন্যে, এখানে আপনার মতো ক্লাউনের প্রবেশ নিষেধ।’
     মনে মনে ভাবলাম,  সারারাত ধরে এতকিছু করার পর শেষরাতে আমি ক্লাউন বনে গেলাম?
     মনের দুঃখে এক গ্লাস শরবত খেয়ে রিকশায় উঠলাম। বাড়িতে পৌঁছে ঘড়িতে দেখলাম রাত তিনটে পাঁচ। মা জেগে জেগে আমার অপেক্ষায় ছিলেন না – খেয়ে ।
      ‘ কোথায় ছিলিরে সারা রাত?’ মা জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, ‘এক বন্ধুর  বিয়ে ছিল। আমিই ছিলাম একমাত্র বরযাত্রী।’
    ‘একমাত্র কেন?’
    ‘ সে অনেক কথা মা। তুমি খেতে বসো।’
    মা বললেন, ‘এত বন্ধুদের বিয়ে করাচ্ছিস, তুই বিয়ে করবি কবে?’
     কথাটা শুনে এত ভাল লাগল যে,  ঠাকুর মহাশয়ের দুটি চরণ  গেয়ে উঠলাম:  আহা, এ কী আনন্দ, হৃদয়ে দেহে ঘুচালে মম সকল বন্ধ।…
    মাকে খাবার টেবিলে বসিয়ে দিয়ে পকেট থেকে সর্বহারাদের লিফলেটটা বের করলাম। সাইক্লোস্টাইল করা একটা কবিতা। কবি ও কবিতার নাম নেই :
                  
                   আর চিৎকার নয় বন্ধু
                    বুকে সংহত করো  ঘৃণা
                    চোখে চোখে কথা বলো
                     ইশারায় ভাঙো সীমা।
                     আর ক্রন্দন নয়
                     করো দৃপ্ত শপথ ঘোষণা
                     দিকে দিকে যাক ছড়িয়ে
                      গোপন প্লাবন রচনা।…
                

Scroll to Top