সেইসব গাছপালা

আমাদের এ পাড়ায় এক এক দিন এক এক রকমের রােদ ওঠে। পূর্ণিমার জ্যোৎস্নও তাই। এক এক পূর্ণিমায়

এক এক রকম। লােকে বললে পাগল ভাববে, কিন্তু কথাটা সত্যি। এখানে রােদ এবং জ্যোৎস্না দুয়েরই গন্ধ আছে।

একটু খেয়াল না করলে এসব বােঝা যায় না। আজকের রােদটা যেমন একটু রাগী টাইপের, গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে।

অল্প। গন্ধটা পােড়া পােড়া। সেনবাবুর বকবক শুনতে শুনতে এগােচ্ছিলাম। এসব বকবক শুনতে খারাপ লাগে না।

এখানে ফুটপাত নেই, রাস্তার ধার ঘেঁযে হাঁটছিলাম দুজনে। একটা বাইক বিপজ্জনক ভাবে আমাদের ধার দিয়ে বেরিয়ে

গেল, সেনবাবুর হুঁশ নেই, বলছিলেন, কিছু কিছু লেইখ্যা রাখছি, বুঝজেন

আগের কতা, মনেও নাই সব। তখন বয়স আর কত, বাইশ-তেইশ হইব.. ।

রায়বাবুসব পারি নাই। কতকাল

বাঁশদ্রোণীর এ জায়গাটায় একেবারে গায়ে-গায়ে সব বাড়ি, অধিকাংশই দোতলা-তিনতলা, গাছপালাও নেই,

ফলে আমার এই সওয়া দুকাঠার ওপর তােলা ছােট একতলা বাড়িটায় হাওয়া-বাতাস খেলে কম। গৃহপ্রবেশের পর বউ

শখ করে নাম দিয়েছিল ‘আশ্রয়। আমার খুব আপত্তি ছিল নামটায়, বউ শােনেনি। কেমন একটা রিফিউজি রিফিউজি

গন্ধ আছে যেন ওই শব্দটার মধ্যে। একাত্তর সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুর থেকে রাজাকারের তাড়া

খেয়ে এসে বনগাঁর শরণার্থী শিবিরে উঠেছিলাম পাঁচ ভাইবােন-বাবা-মা সুদ্ধু গােটা পরিবারসেই দুঃসহ দিনগুলাের

সাতকাহন যেন পােরা আছে ওই শব্দটায়। ভাসা ভাসা খবর পাওয়া যাচ্ছিল, ঘরবাড়ি বলতে আর কিছু নেই। লুটপাট

হয়ে গেছে সব। তবু যুদ্ধের পর বাবা একবার দেশে গিয়েছিলেন, কী দেখে এসেছিলেন কে জানে, আর ফিরে যাবার

কথা মুখে উচ্চারণও করেননি। হাবড়ায় আমাদের গ্রামের অনেকে এসে বাড়িঘর করেছিল, মায়ের গয়না বিক্রি করে

সেখানেই দুখানা ঝুপড়ি ঘর আর স্টেশনধারে একখানা মুদিখানা দিয়ে শুরু হয়েছিল নতুন জীবন।

চারদিকটা ভাল করে দেখে নিয়ে সেনবাবু বললেন, বাড়িখান ভালই করছেন। পােলামাইয়ারা সব কই ?

বছর দুয়েকের আলাপ সেনবাবুর সঙ্গে, তবে ফ্যামিলি নিয়ে কথাবার্তা হয়নি কোনওদিন। বোেড়ালের দিকে

কোন এক আত্মীয়বাড়িতে থাকেন। তবে মানুষটা যে একা তা খুব বােঝা যায়। গড়িয়ায় মাঝে মাঝে দেখা হয়। চোরাই

পথে বাংলাদেশে যাতায়াত আছে এখনও। দেশের মানুষ, দেশের গল্পসল্প শােনার জন্যেই মাঝে মঝে বাজারের মুখে

রতনের চায়ের দোকানে ওঁকে নিয়ে বসি। এখানকার কোনও রাজনৈতিক দল নিয়ে আগ্রহ নেই সেনবাবুর, সামনের

নির্বাচনে বি এন পি, আওয়ামি লিগ কে কত পারসেন্ট ভােট পাবে তারই চুলচেরা বিশ্লেষণ শুনি। আজ বাজার সেরে

বেরিয়ে দেখি রতনের দোকানে সেনবাবু বেজারমুখে বসে আছেন, পঞ্চায়েতের ইলেকশনের জন্যে বর্ডারে খুব কড়াকড়ি,

ঘােজাডাঙা বর্ডার থেকে ফিরে এসেছেন কাল সন্ধেবেলায়। দালাল বলেছে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙোেতে গিয়ে দুদিন

আগেও বি এস এফ-এর গুলি খেয়ে একজন ফুটেছে। বি জি বি বডি টেনে নিয়ে গেছে ওপারে। আবার কবে সব

ঠিকঠাক হবে বলা মুশকিল।

তাে কী আর করা, মানুষটাকে ধরে নিয়ে এলাম বাড়িতে। এখনও মুখের উদাস ভাবটা কাটেনি, বারান্দার

মাদুরে বাবু হয়ে বসে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে চিলতে আকাশ দেখছিলেন, বললাম, মেয়ে নেই, পােলায় কাজ করে

বাঙ্গালােরে।

পােলার বিয়া দিছেন?

ছুটি-ছাটায় দু-তিনদিনের জন্যে বাড়ি এলে বউ বিয়ের কথা তুললেই ছেলে মুখ করে, কী চাও তােমরা ? বন্ধুরা

সব স্টেটস-এ চলে যাচ্ছে আর আমি বউ নিয়ে এই বাঁশদ্রোণীর খাটালে পড়ে থাকব? ঘরসংসার করব ?

খাটাল শব্দটা বউয়ের মুখে শুনে বুকের খুব ভেতরে প্রমাণ সাইজের একটা ছুঁচ বিধে গিয়েছিল। একটা দেশ

থেকে ঘাড়ধাক্কা খেয়ে অন্য একটা দেশে এসে দুখানা পাকাঘর, বাথরুম, কিচেনএসব করতে করতেই একটা জীবন

শেষ হয়ে এল। পঞ্চাশের পর থেকেই শুরু হয়েছে সকালে ব্রেকফাস্টের আগে ডায়াবেটিসের ওযুধ, ব্রেকফাস্টের পর

প্রেশারের বড়ি। গেল সপ্তাহে প্রেশার মেপে মুখ গম্ভীর করে ফেলেছিলেন সেবায়ন ক্লিনিকের ডাক্তার মাইতি, ভুরু কুঁচকে

সন্দিগ্ধ গলায় বলেছিলেন, প্রেশার একটু ওপরের দিকে দেখছি, পাতে কাঁচা নুন খাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছেন নাকি ? রােজ

ভােরে দুকিলােমিটার হাঁটতে বলেছিলাম, হাঁটছেন তাে?

মিনমিন করে বলেছিলাম, রােজ হয়ে ওঠে না, ডাক্তারবাবু। তবে হাঁটি, পারতপক্ষে রিকশা-অটোয় উঠি না।

বিরক্ত মুখে ডাক্তার মাইতি বলেছিলেন, নুন-মিষ্টি চিরকালের জন্যে বন্ধ। দুই কিলােমিটার হাঁটা মাস্ট,

যখনতখন নয়, নিয়ম করে রােজ ভােরবেলায়। আর কটা ইনভেস্টিগেশন লিখে দিচ্ছি, নেক্সট টাইম ওগুলো করিয়ে

নিয়ে আসবেন। এবারে আর ওযুধ বাড়ালাম না। ই সি জি, লিপিড প্রােফাইল। প্রেশার না কমলে ডােজ বাড়িয়ে দিতে

হতে পারে… ডায়াবেটিস কন্ট্রোল না করলে কিডনি, চোখ সব যাবে।

অথচ এখনও টুকটাক কত কাজ বাকি। ছাদের ওপর ছেলে-বউমার জন্যে ঘর, টয়লেট, ব্যালকনিএসবের

প্ল্যান ছিল, সব কি আর এক জীবনে শেষ করা যাবে ? ছেলে খাটাল বললেও আমার দায়িত্ব আমাকেই করে যেতে

হবে। আমার বউ এদেশের মেয়ে, পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে সম্বন্ধ করে বিয়ে, সে অতশত বােঝে না। মুক্তিযুদ্ধের সময়

ক্লাস থ্রি কি ফোর-এ পড়ত বােধহয়। তার নাকি চোখে জয় বাংলা হয়েছিল সে বছর। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বলতে এ ছাড়া

আর কিছু মনে নেই। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি মুক্তিযুদ্ধ বলতেন না, বলতেন বাংলাদেশের গােলমালের বছর।

গেল বার পুজোর পরে বাংলাদেশ থেকে ফিরে সেনবাবু একদিন বলেছিলেন, এইবার ফরিদপুর ট্যুর কইরা

আইলাম। আমার এক খুড়াক্তো ভাইয়ের পােলায় ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের লেকচারার, বুঝলেন। তার বইনে

বড়লােক এক ব্যবসায়ী মুসলমানরে বিয়া করছে প্রেম কইরা। ধর্ম পালটাইয়া এখন নমাজ-টমাজ পড়ে, রােজা রাখে,

হিজাব পরে, হজও কইরা আইছে কইল। বাড়িতে দুইখান গাড়ি, দাস-দাসীকোনও কিছুর অভাব নাই। বেশ আছে।

তবে দাদার লগে সম্পর্ক নাই। দাদা কট্টর হিন্দু, নরেন্দ্র মােদীর সাপােরটার। বােনের নামােচ্চারণ পর্যন্ত করে না সে।

ভাইঝি একদিন নেমন্তন্ন করছিল। গেছিলাম তারে দ্যাখতে, গিয়া দেহি এলাহি আয়ােজন। দুই-তিন রকমের

মাংসের প্রিপারেশন, বিরিয়ানিএই বয়সে এত কি খাওন যায়, কন দেহি ? কানের কাছে মুখ আইন্যা ভাইঝি ফিস

ফিস কইরা কয়, নিশিন্তে খান, কাকা। আপনে আইবেন বইলা আইজ শুধু খাসি আর মুরগি ছাড়া কিছু ঢােকে নাই

বাড়িতে। ঠাকুরের নাম লইয়া পেট ঠাইস্যা খাইয়া দিলাম একখান ঘুম। তাে একদিন হঠাৎ আপনের গেরামের কথা মনে

পড়ল, চুপি চুপি ভাইঝিরে কইতে সে কইল, এমন দূরে তাে নয়, ড্রাইভাররে কইয়া দিলেই ঘুরাইয়া আনব। গেছিলাম

ঘুরতে, ঘণ্টাখানেকের পথ। একেবারে আপনে যেমন যেমন কইছিলেন ঠিক সেইরকমই সব দেখলাম। তাহের মিয়াঁ

আপনেরার দালানকোঠা সব রিপেয়ার কইরা ফালাইছে, সামনের পুকুরটারেও মনে হইল কাটাইয়া রুই-কাতলার পােনা

ছাড়ছে। তার দুই পােলায় থাকে সউদি আরব, সেখান থেইক্যা টাকাপয়সা পাঠায় বিস্তর, কী সুন্দর যে লাগল আপনেরার

বাড়িখান, কী কমু! তাহের মিয়াঁ আপনেরার কথা জিগাইল, বারেবারে কইয়া দিল একবার যেন আপনে গিয়া ঘুইরা

আসেন।

চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি সব। সন্ধে নামছে সবে, পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে ছােড়দি হাত নেড়ে

ডাকছে, চই চই চই! সার দিয়ে পাতিহাঁসগুলো প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে উঠে আসছে। হাঁসের খোঁয়াড়ে তুলে আগল

দিয়ে তবে ঘরে আসবে সে। ভামবেড়ালের খুব উপদ্রব ছিল, সুযােগ পেলেই হাঁসের গলা কামড়ে ধরে বাড়ির পশ্চিমে

বাঁশবাগানের ভেতর সেঁধিয়ে যেত ভামগুলো। পুবের কোঠাঘরে মেঝের মাদুরে হ্যারিকেন জ্বেলে আমি ভরসন্ধেবেলায় তখন যাদবচন্দ্রের পাটিগণিত নিয়ে বসেছি। সামনে হায়ার সেকেন্ডারি। জানালার বাইরে লিলি ফুলের ঝাড়ে তারস্বরে

ঝিঝি ডাকছে। বিয়ালিশ বছর পর এখনও দিক ঠিক করতে চোখ বুজে পুবের পুকুর আর পশ্চিমের প্রকাণ্ড ডেওয়া

গাছটার প্রয়ােজন হয়। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পশ্চিমে একটা ডেওয়া গাছ

দেখেছিলেন?

হয়তাে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে করেই সেনবাবু বলেছিলেন, দেখছি, দেখছি ! কত গাছপালা

আপনেরার বাড়িতেনাইরকেল গাছই তাে মনে হয় যাইট-সত্তর খান হইব।

ছেলের বিয়ে নিয়ে সেনবাবুর প্রশ্নটায় একটু অস্বস্তিতে পড়ে যাই, একটা শ্বাস ফেলে মিথ্যে করে বলি,

দেখাশুনাে চলছে, দেখা যাক কী হয়।

সেনবাবু কী বুঝলেন কে জানে, বললেন, হ, সবই হইল গিয়া প্রজাপতি নিব্বন্ধ।

কিচেনের দিক থেকে এখনও সাড়াশব্দ পাচ্ছি না, তার মানে এখনও চায়ের জল চড়েনি উনুনে। একটু

আশঙ্কা হচ্ছে, ঘরে চা-চিনি-বিস্কুট শর্ট পড়লে এতক্ষণে ভেতরে ডাক পড়ত। দেশের মানুষটাকে নিজে থেকে ডকে

আনলাম, এক কাপ চা আর দুখানা থিন অ্যারাবুট বিস্কুট না হলে মান থাকে ? বউকে বলতে গেলে কী বলতে কী

বলবেবরং চুপ করে আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে দেখা যাক। বউয়ের মুড চাঙ্গা না হলে সেনবাবুকে নিয়ে

মেট্রো স্টেশনের কাছে মহামায়া রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসা যাবে।

পুবদিকে রাস্তা হওয়ায় পুবের বারান্দাটা একটু আলাে পায়। দুপুর দশটার পর কয়েক ঘণ্টার জন্যে রােদও এসে

পড়ে থাকে এখানে। পাছে উটকো টাইপের লােকটা বসবার ঘরের সােফায় নােংরা জামাকাপড়সুদ্ধু গ্যাঁট হয়ে বসে পড়ে

সেই ভয়ে গ্রিল খােলার আগে লােকটাকে বাজারফেরত আমার সঙ্গে দেখেই বউ বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে দিয়ে গেছে।

সেখানেই আমার মুখােমুখি বসে আছেন সেনবাবু। দেশের মানুষ পেলে আমি মাঝে মাঝে ধরে নিয়ে আসি বাড়িতে, বউ

সেজন্যে এক একদিন মুখ করে খুব। কসপ্তাহ আগে যেমন কাঠের মিস্ত্রি নিবারণকে ধরে এনেছিলাম। রান্নাঘরের

উনুনের নীচেটায় পাল্লা করে দেবার জন্য বউ-ই বায়না করছিল বেশ কদিন ধরে। রােববার সকালে গড়িয়া থেকে বাজার

সেরে ফেরার পথে রথতলার নিউকালী ফারনিশারস-এ উকি মেরে দেখি মালিক মােবাইল কানে চেপে খুব বেজার মুখে

কাকে বলছে, হ্যাত্তারে বারম্বার মানা কইত্তেছি, হ্যাত্তায় হােনে না…টিয়া কি গাং দিয়া ভাইস্যা আহে !

টিয়া মানে টাকা। খাঁটি নােয়াখালীর লােক, সাতচল্লিশের পরে না একাত্তরের পরের রিফিউজি এখনও পরিষ্কার

নয়। নােয়াখাইল্যার সঙ্গে সামান্য ঢাকাইয়া ভাষার মিশেল আছে। মালিক আমার দিকে মুখ তুলতেই বললাম, বাড়ি

নােয়াখালী তাে?

লােকটার বেজার মুখে হাসি ফুটল, অবাক কাণ্ড ! আন্নে বুঝলেন কী কইরা ?

ওই যে বললেন, টিয়া।

গলা নামিয়ে লােকটা বলল, ঠিক ধরছেন। আমার নাম নিবারণ বারুই, বাড়ি মাইজদি। বিয়া করছিলাম

লাকসাম। একাত্তর সনে…

সেই এক গল্প। আমার নিজের গল্পটাই ফিরে না শুনে কথার মাঝখানে বলে উঠলাম, দোকান কত দিনের ?

এক গাল হেসে নিবারণ বলল, তা বচ্ছর ত্রিশ-বক্রিশ হবে। নােয়াখালী লেখলে কে কী ভাববে, হেই কারণে

নাম দিছিলাম নিউকালী ফারনিশারস। লইক্ষ করছেন কি, নিউ আর কালীর মইদ্যে কুনও গ্যাপ নাই ? দেশের নামও

থাকল, ঠাকুরের নামও করা হইল। কী কন?

হিসেব মতাে নিবারণের বয়স আমার সামান্য কমবেশি হবে। তবে বেঁটেখাটো শক্তপােসক্ত চেহারা, মাথার চুলে

এখনও পাক ধরেনি। কথাটা বলতে প্রায় লুফে নিল, খরচার কথা তুলতেই দিল না, নােয়াখাইল্যা টানে শুধু বলল,

আন্নে আমার দেশের লােক, আগে কামখান দেখেন, তারপর আরি যা দিবার দিবেন।

পরদিন সকালে সাইকেল নিয়ে এসে হাজির। বাঙালদের ব্যাপারে আমার বউ একটু সতর্ক, আমি বারান্দায়

বসে সিগারেট টানছি, কিচেনে কী কী করতে হবে বউ নিবারণকে বােঝাচ্ছে। নিবারণ খুব মনােযােগ দিয়ে মাপজোক

করছিল, দুহাজার টাকা অ্যাডভান্স নিয়ে গেল যাবার সময়। তারপর দিন যায়, মাস যায় নিবারণের আর দেখা নেই।

বারকয়েক খাোঁজ করতে গিয়ে দেখি নিউকালী ফারনিশারস-এর ঝাঁপ বন্ধ। বউকে আর স্তোকবাক্য দিয়ে দমিয়ে রাখা

যাচ্ছে না। প্রতিদিনই প্রায় বাঙালদের গুষ্টি উদ্ধার চলছে। এরই মধ্যে একদিন রিকশা-ভ্যানে মালপত্র নিয়ে এসে

নিবারণ উপস্থিত। মুখখানা কেমন চিন্তামগ্ন, বিষগ্ন। তিনচার দিন টানা কাজ করে পাল্ল ফিট করে পালিশ করে দিল।

বউ খুশি, আমিও নিশ্চিন্ত। যাবার সময় টাকাপয়সা বুঝিয়ে দেবার ছুতােয় গেটের কাছে একটু আড়ালে ডেকে বললাম,

মনটা কদিন আপনার খুব ব্যাজার দেখছি, নিবারণ ?

স্নান হেসে নিবারণ বলল, নিউকালী ফারনিশারস-টা ভাবতেছি এইবার তুইল্যা দিয়াম।

কেন? হঠাৎ আবার কী হল ?

ছেইলারে বি এ পাশ করাইলাম, দুই বচ্ছর কম্পুটার না কী পড়ল। চাকরিও পাইল সন্টলেক না কুথায়, ছেলের

জইন্যে বাড়িঘর করলাম, বিয়া দিমু ভাইব্যা ধারদেনা কইরা ঘরও করলাম একখান। তিন মাসও কাটল না, হ্যাত্তায়

প্রেম কইরা বিয়া কইরা বসল। বাপ-মারে একখান খবর পর্যন্ত দিল না। বাড়ি ভাড়া বােধ হয় আগেই কইরা রাখছিল,

বউ নিয়া সেইখানেই গিয়া উঠল।

কী ভেবে বলতে গেলাম, ভালই তাে হল, দায়মুক্ত হলেন। ঘরেঘরেই তাে এ জিনিস হচ্ছে, মন খারাপ করে

আর কী করবেন?

হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল মানুযটা। গ্রিলের শব্দ পেয়ে পেছন ফিরে দেখি গ্রিল ধরে বউ দাঁড়িয়ে।

বউয়ের তর সইছিল না, নিবারণ চলে যেতে বলল, লােকটা ওরকম করে কাঁদছিল কেন গাে ?

বউয়ের প্রতিক্রিয়া কী হবে জানি না, মিথ্যে করে বললাম, ওই আর কি, দেশবাড়ির কথা মনে পড়ছিল।

মুখ বেঁকিয়ে বউ বলল, ন্যাকা !

কাঁধের ঝােলা ব্যাগটা দুজনের মাঝখানে নামানাে। নভেম্বর শেষ হয়ে এল, এখন বেলা দশটার রােদের তেজও

একটু মিইয়ে এসেছে, শুনশান নীল আকাশে কয়েক খণ্ড মেঘ চরে বেড়াচ্ছে। খালের দিক থেকে একটা চোরা হাওয়া

আসছিল, তাতে এ অঞ্চলের কুখ্যাত দুর্গন্ধ।

সেনবাবু পকেট থেকে একটা বিড়ি বার করে ধরালেন, উঠে ড্রয়িংরুম থেকে অ্যাশট্রেখানা নিয়ে এসে সামনে

রাখলাম। আজ এমনিতেই না বলেকয়ে কাজের মাসি কামাই করেছে, বউয়ের মেজাজ তিরিক্ষি, তার ওপর বিড়ির

টুকরাে বারান্দায় দেখতে পেলে আর রক্ষা নেই, এমনকী গ্রিল গলিয়ে ছাঁচতলাতেও ফেলা বারণ। ছাইরঙা ট্রাউজারসের

ওপর নীল ডােরাকাটা হাফশার্ট, একমাথা কাঁচাপাকা চুল, একহারা পােক্ত চেহারা, মুখে কদিনের বাসি কাঁচাপাকা দাড়ি,

ছফুটের কাছাকাছি হবেন দেখলেই বােঝা যায় বাউন্ডুলে লােক। গড়িয়ার মাছের বাজারে হঠাৎ আলাপ বছর দুয়েক

Page 5

আগে। শ্রাবণের শুরু, সবে ইলিশ উঠেছে। আমার পরিচিত মাছওলা বলছে, নিশ্চিন্তে নিয়ে যান, বাবু, খাঁটি পদ্মার

ইলিশ। খেয়ে ভাল না লাগলে পয়সা ফেরত।

রুপােলি মাছটার পেট টিপে ডিম আছে কিনা বােঝবার চেষ্টা করছিলাম, তখনই কানের কাছে মুখ এনে কে

যেন ফিসফিস করে বলল, নিবেন না, দাদা। মিছা কথা কইতাছে, এ হইল গিয়া খাঁটি ডায়মন্ড হারবার, মােহনায়

ঢােকার আগেই ধইরা ফালাইছে। তার ওপর ছেলে ইলিশ, অখাইদ্য !

ইলিশের আবার জেন্ডার হয় নাকি ? জীবনে প্রথম শুনলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে মানুষটাকে দেখছিলাম। কাঁধে ঝােলা

ব্যাগ, বাজারের থলেফলে কিছু নেই হাতে, বাজারের ভিড়-ঠেলাঠেলির মধ্যেই হাত জোড় করে নমস্কার করে বলল,

আমার নাম তারক সেন, বাড়ি কুমিল্লা ডিসট্রিক্ট। মাঝে মাঝে বাজারে ঢুইক্যা হেয়াগাে কামকারবার দেখি। আপনে ত

ফরিদপুর ?

মাছ কেনা মাথায় উঠল, চোখ কপালে, ভিড় কাটিয়ে একটু ফাঁকায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ফরিদপুর বুঝলেন

কী করে ?

সেনবাবু রহস্য করে বললেন, এক জন্মে কি আর গলার টান ঝাইড়া ফ্যালান যায় ? আপনেরার জেলার কত

বিখ্যাত লােক আছে কইলকাতায়মৃণাল সেন, সুনীল গাঙ্গুলী… ।

মনটা খারাপ হয়ে গেল, চল্লিশ বছরেও তাহলে এ দেশের ভাষাটা রপ্ত হল না। কিন্তু ইলিশের জেন্ডারের

ব্যাপারটা মাথা থেকে সরছিল না, বললাম, চলুন, একটু বসি কোথাও।

বাজারের বাইরেই খানিকটা ফুটপাত দখল করে রতনের দোকান, ফুটপাতেই দুখানা বেঞ্জি পাশাপাশি পেতে

রাখা। এসে বসলাম দুজনে। রতনকে বলতে হল না, কাচের ছােট গ্লাসে চা রেখে গেল দুজনের মাঝখানে। আমার তর

সইছিল না, বললাম, ওই যে ইলিশের কথাটা বলছিলেন…।

চায়ে চুমুক দিয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে ফেললেন সেনবাবু, পর পর দুটো টান দিয়ে বললেন, সব প্রাণীর মধ্যেই

ছেলে-মেয়ে আছে, ইলিশের মধ্যেও আছে, বুঝলেন ? কানকো দেইখ্যা চিনতে হয়। হে একদিন আপনেরে চিনাইয়া

দিমুঅনে।

সেই চেনাটা এখনও হয়নি। সেনবাবুর হাতে ধরা বিড়িটা নিভে গেছে, আকাশের দিকে যে ভাবে তাকিয়ে

আছেন মনে হচ্ছে দেশের আকাশ নিয়ে একটা কিছু বলবেন এক্ষুনি। বউ এসে স্টিলের বাটিতে দুজনের মাঝখানে

মুড়িমাখা নামিয়ে রেখে গেল নিঃশব্দে। কুচনাে পেয়াজ-কাঁচালঙ্কার গন্ধ পেয়েই কিনা কে জানে আমার দিকে মুখ

ফেরালেন সেনবাবু। উদাস চোখের দৃষ্টি। মুড়িমাখা নয়, ঝােলা ব্যাগটার দিকে হাত বাড়ালেন। ভেতর থেকে একটা

মােটা বাঁধানাে খাতা বের করে বললেন, যদি বিরক্ত না হন তবে দুইচাইর পাতা পইড়া শোনাই।

খাতার সাইজ দেখে একটু আশঙ্কাই হচ্ছিল, এ খাতা আধাআধি পড়লেও বেলা কাবার হয়ে যাবে, তবু

বললাম, পড়ুন, শুনি।

সেনবাবু পড়তে শুরু করলেন, সাল ১৯৭১। এপ্রিল মাস। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনী গণহত্যা

চালাইয়াছে। বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার কারাগারে বন্দি। দিকে দিকে স্লোগান উঠিতেছে, বীর বাঙালি অস্ত্র

ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। আমার বয়স তখন বাইশ কি তেইশ হইবে। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি খবর পাইলাম

পাকবাহিনী গঞ্জের বাজারে ক্যাম্প করিয়াছে। পরদিন ভােরবেলায় এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখিলাম। হাজার হাজার মানুষ

ঘরবাড়ি ছাড়িয়া প্রাণের ভয়ে আগরতলা সীমন্তের দিকে ছুটিতেছে…

এই একই গল্প আজ পর্যন্ত কত বার যে দেশের মানুষের মুখে শুনেছি বলতে পারব না। আমার নিজের গল্পটাও

প্রায় একই। জানি এরপরই শুরু হবে হত্যালীলার বর্ণনা। মৃত্যুর মিছিল। ভাগ্যিস এই জায়গায় এসে সেনবাবু একটু পজ দিলেন আর ঠিক তখনই আমার বউ ট্রেতে করে দুকাপ চা নামিয়ে রেখে গেল আমাদের দুজনের মাঝখানে। সেনবাবু

খাতা ভাঁজ করে মুড়ির বাটি তুলে নিলেন। দৃষ্টি উদাস, মুখ দেখে মনে হচ্ছে নতুন করে আর পড়া শুরু করবেন না।

দেখতে চাই না, তবু দেখছি। আমাদের পুকুর, পাড় ঘেঁষে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছ, পশ্চিমের ডেওয়া

গাছের মাথায় শেষ বিকেলের রােদসব কেমন ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি চোখ বুজে সেই ২৫শে মার্চের ভয়ংকর

দৃশ্যটা দেখছি আবার। সন ১৯৭১।

Scroll to Top