সাধারণের কাছে রবীন্দ্র চিত্র
তর্কের খাতিরে যদি ভাবি, আজ যদি রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতেন, ছবি পোষ্ট করতেন ফেসবুক
ইনস্টাগ্রামে, কিরকম সাড়া ফেলতো তার ছবি? কটা লাইক পেতেন?
আহা! ব্যাথা পাবেন না, রাগ করবেন না এই প্রশ্নে। জানি সিরিয়াস ছবি আঁকিয়ে এসব লাইকের তোয়াক্কা
করেননা ,তারা তো থাকেন সৃষ্টি নিয়ে বিভোর । তবু যেহেতু আমার লেখার বিষয় সাধারণের কাছে রবীন্দ্র
চিত্র, সেই সাধারণ মানুষের মনের খোঁজ তো এইসব মাধ্যমেই পাওয়া যায়, নতুবা এই বিশাল
তথ্যভান্ডার রাজনীতিক থেকে অর্থনীতির কারবারীদের কাছে এত মূল্যবান কি করে? এমন কি শোনা
যায় আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মহাশয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই তথ্য কাজে লাগিয়ে ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে গবেষকরা অনেক কাজ করেছেন, আগামীতেও করবেন। শিল্পী
গবেষকরা বলেন- ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক যুগের প্রবর্তক এবং প্রথম
শক্তিমান শিল্পী।
এত গেল ক্রিম স্তরের মানুষের অনুভব,কিন্ত সাধারণ মানুষের কাছে? সত্যিই কি কিছু পরিবর্তন হয়েছে
একশ বছরে? এই যে এত শিল্প গ্যালারি এত শিল্পীদল, এত চর্চা, কিন্ত তার অভিঘাত কি সাধারণের মধ্যে
ছড়িয়েছে? রবীন্দ্রনাথের ছবিকে বুঝতে গেলে যে মননের প্রয়োজন, ছবিটা আসলে কি, সেই শিক্ষায় কি
সাধারণ মানুষ কে আমরা শিক্ষিত করতে পেরেছি?
যদি আজ থেকে একশ বছর পিছিয়ে যাই, তখন তাঁর ছবিকে বাংলা তথা দেশের মানুষ কি ভাবে
দেখতেন? বা পাশ্চাত্য মহল তার ছবিকে কিরকম সমাদর করতো?
১৯৩৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লেখা এক চিঠিতে তিনি অমিয় চক্রবর্তী কে বলছেন -” বাক্যের
সৃষ্টির উপরে আমার সংশয় জমে গেছে, এত রকম চলতি খেয়ালের ওপর তার দর যাচাই হয়, খুঁজে
পাইনা তার মূল্যের আদর্শ । …..এই টলমল অবস্থায় এখনো দুটো পাকা ঠিকানা পেয়েছি আমার
বাণপ্রস্থের – গান আর ছবি”।
তার চিত্রকলার প্রতি পাশ্চাত্যের এই আগ্রহ দেখে রবীন্দ্রনাথ প্রথমটায় বিস্মিত ও পরে অভিভূত
হয়েছিলেন, এটা আর ও বেশি করে এইজন্য হয়েছিলেন যে, স্বদেশের মানুষের মন তাঁর চিত্রকলায়
তেমনভাবে সাড়া দেয়নি, এ ব্যাপারে তাদের মনোভাব ছিল নিরুচ্ছাস,তেমনি সন্দিগ্ধ।
সময়টা আমরা যদি বুঝবার চেষ্টা করি, ১৯১২ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে সাতবার ইউরোপ গিয়েছিলেন
তিনি এবং সব মিলিয়ে সাড়ে পাঁচ বছর সেখানে কাটিয়ে ছিলেন, পাশ্চাত্যে তখন যে ধরনের শিল্পচর্চা
চলছিল, খুব কাছ থেকে তাকে অনুধাবন করেন। সেই শিল্পচর্চা তার মনে সাড়া জাগায়, শিল্পের স্বাধীনতা
বলতে পাশ্চাত্য পৃথিবীতে তখন কী বোঝায়,তার একটা ধারণা তার হয়। ১৯২৫ সালে পশ্চিমের
ডায়েরিতে তিনি লেখেন – ” য়ুরোপের চিত্রকলার ইতিহাসে একটা বিপ্লব এসেছে,দেখতে পাই…….ছবির
সেই গোঁড়াকার ছাঁদের মধ্যে ফিরে না গেলে এই অবান্তর ভারপীড়িত আর্টের উদ্ধার নেই ” ।
রবীন্দ্রনাথের সমস্ত ছবিই তার জীবনের শেষ সতেরো বছরে আঁকা, যা শুরু হয়েছিল কিছুটা
খেলাচ্ছলেই, পূরবী পান্ডুলিপিতে লেখা কাটাকুটি থেকে, সেই আঁকিবুকি ক্রমশ বিভিন্ন রূপ নিতে
থাকলো। তখন ১৯২৪ সালে তিনি বিদেশে, কিছুটা অসুস্থ, এই সময়ে বুয়েনোর্স এয়ার্সে শ্রীমতি
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথ্য গ্রহন করেন, ওকাম্পোর মনে ছিল তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা , মায়া মমতা,
তিনি পূরবী পান্ডুলিপির এই আঁকিবুকি দেখে বিস্মিত হন, কবিকে প্রবল উৎসাহ জোগান। সেখানের
অনেক শিল্পীকে এই আঁকিবুকি থেকে হয়ে ওঠা ছবি দেখান, তারাও বিস্মিত হন। অবশেষে ১৯৩০ সালে
প্যারিসের গ্যালারি পিগ্যালে কবির যে চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় তার ও তক্তাবধানে ছিলেন ভিক্টোরিয়া
ওকাম্পো ।
রবীন্দ্রনাথের এই প্রদর্শনীর উপলব্ধি শোনা যাক – ” দক্ষিণ ফ্রান্সের জনাকয় শিল্পী এর মধ্যে এমন কিছু
দেখেছেন, যা নাকি তারা তাঁদের ছবির মধ্যে ধরতে চাইছেন কিন্ত পারছেন না”।
এত প্যারিসের উপলব্ধি ,এই প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ছে। এর বহু বছর পর শিল্পী পরিতোষ সেন
প্যারিস গেছেন, ল্যুভর, নোতারদাম, মমার্ত
সহ বিভিন্ন গ্যালারি ঘুরে দেখছেন, একদিন সেখানের এক সেলুনে গেছেন, ঢুকে দেখেন দেওয়াল জুরে
আধুনিক ফরাসি শিল্পীদের ছবির প্রিন্ট ঝুলছে, চুল কাটার সঙ্গে সঙ্গে পরিতোষ সেন শিল্পী জেনে সেই
নরসুন্দর রীতিমত আলোচনা করছেন ক্লদ মোনে বা পাবলো পিকাসোকে নিয়ে, তিনি বিস্মিত
হয়েছিলেন, সেখানের সাধারণ মানুষের এই শিল্পের প্রতি ভালোবাসা দেখে।
রবীন্দ্রনাথের প্যারিসে প্রদর্শনীর পর জার্মানিতে প্রদর্শনী হয়, সেখানে জার্মান শিল্প সমালোচকরা
আকুন্ঠিত প্রশংসা করেন তার ছবির। এরপর মস্কোর প্রদর্শনী ,সেখানে তাকে আখ্যায়িত করা হয় প্রধান
শিল্পী হিসেবে।
যদি বহিঃবিশ্বের তদানিনতন সময়ের নিরিখে তার কাজের মূল্যায়ন স্বদেশের সাথে তুলনা টানা
হয়, তবে তা হতাশাজনক। যে আধুনিকতা ও মননের প্রয়োজন ছিল তার কাজকে বুঝতে, তার
অনুপস্থিতিতে লক্ষ্য করা যায়।
অজন্তা মোঘল রাজপুত পাহাড়ি চিত্রকলা পর্ব পার করে পশ্চিমের রেনেসাঁস উত্তর শিল্প সাধনা
এদেশের মনোভূমিতে প্রবাহিত হবার সুযোগ পায়নি। উপযুক্ত শিক্ষক ছিলনা, যেসব আর্টস্কুল ছিল
সেগুলোর দৌড় ছিল নকল নবীস বানানো। ধনীদের পৃষ্ঠপোষকদের জন্য ফরমায়েসী প্রতিকৃতি আঁকা
হত। এর কিছুকাল পর অবনীন্দ্রনাথ এক শিল্প আন্দোলনের সূচনা করেন। হ্যাভেল, কুমারস্বামী,
ওকাকুরা ,নিবেদিতা সেই পরীক্ষা নিরীক্ষা কে সমর্থন যুগিয়েছিলেন।
এই শিল্প আন্দোলনের ঘরাণা নিয়ে যথেষ্ট প্রচার হয়, তাদের ছবি প্রিন্টের মাধ্যমে বেশ কিছু শিক্ষিত
জনের পরিচয় ঘটে। কিন্ত সেই আন্দোলনে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছিল, অবনীন্দ্রনাথরা যে
আন্দোলন করছিলেন তার দুর্বলতা রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়ায়নি । প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে জাপানে এবং
পশ্চিমে ঘোরার অভিজ্ঞতা তাঁর মনে ভারতের সমকালীন আন্দোলনের অন্তঃসার শূন্যতাকে স্পষ্ট করে
তোলে, মীরা দেবীকে চিঠিতে (১৭ই আশ্বিন, ১৩২৩ ) ক্ষোভ জানিয়ে লেখেন- আশা করেছিলুম বিচিত্রা
থেকে আমাদের দেশে চিত্রকলার একটা ধারা প্রবাহিত হয়ে দেশের চিত্তকে অভিষিক্ত
করবে…….কিছুরই সৃষ্টি হলনা, কিছুই প্রাণ পেলোনা সেই বেদনা কোথায়, কল্পনা কোথায়, আত্মবলিদান
কোথায় যার জোরে বিধাতার অভিপ্রায়কে মানুষ সার্থক করে তোলে?
কলকাতায় তার বাসভবনে একটা অংশে বিচিত্রা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে শিল্প আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে
ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, স্বপ্ন দেখেছিলেন, ভেবেছিলেন পাশ্চাত্যের ধাঁচে এখানেও চিত্রশিল্পে আধুনিকতার
আমদানি হোক এই আন্দোলনের হাত ধরে, কিন্ত তার স্বপ্ন সফল হয়নি, এই বিচিত্রা অচিরেই ব্যর্থ হয়,
তিনি দুঃখ করে চিঠিতে মীরাদেবীকে লেখেন-“দুঃখের বিষয় এই যে, বাঙালির প্রতিভা যথেষ্ট আছে কিন্ত
উদ্যম ও চরিত্রবল কিছুই নেই। আমরা নিজের দেশকে এবং কাজকে একটা বৃহৎ দেশ ও কালের উপর
দাঁড় করিয়ে উদারভাবে দেখতে জানিনে।…..একটু ফুঁ লাগলেই, সেই শিখা নিভে যায়, তারপর আবার
যেমন অন্ধকার তেমনি অন্ধকার। আশা করেছিলুম বিচিত্রা থেকে আমাদের দেশে চিত্রকলার একটা
ধারা প্রবাহিত হয়ে সমস্ত দেশের চিত্তকে অভিষিক্ত করবে কিন্ত এর জন্য কেউ যে নিজেকে সত্য ভাবে
নিবেদিত করতে পারলেনা…..।
আমাদের দেশের সেলুনে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রিন্ট আমরা কোথাও দেখতে পাবোনা, অথবা
রামকিঙ্কর নন্দলালের, এ কষ্ট কল্পনাই রয়ে গেল। বিশ্ব যুদ্ধের পর ভারতের অর্থনীতি একেবারেই
গুঁড়িয়ে ভেঙে পড়ে, তার সাথে যোগ হয় দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা। সেই বিপর্যয়ের পর দৈনন্দিন বেঁচে থাকার
রসদ জোগানোর সংগ্রাম। আজ এত বছর পরেও তার রূপ বদলেছে কিন্ত চরিত্র কিছুমাত্র বদলায়নি,
সেখানে রবীন্দ্র চিত্র? তার গান যতখানি সাধারণের কাছে পৌঁছুতে পেরেছে, সেখানে তাঁর ছবি কয়েক
যোজন পিছিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ছবির ভাবনাতে অবগাহন করে পরবর্তীতে বহু শক্তিশালী শিল্পীকে
আমরা পেয়েছি, কিন্ত তাঁর ছবির ব্যাখ্যা ও অনুভবকে কতটা ছড়িয়ে দিতে পেরেছি সাধারণের জন্য। তা
প্রশ্ন রেখেই যায়।
ছবি মানেই যে আঙ্গিকের মসৃণতা, অঙ্কণ দক্ষতা আর প্রথাগত শুদ্ধি নয়, এছাড়াও সার্থক চিত্রকর্ম
সম্ভব । এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কি বলছেন – প্রকাশের প্রবল তাগিদ থাকলে আদিকালের মানুষের
অশিক্ষিত পটুত্ব ছবি আঁকার পক্ষে যথেষ্ট।
এই কথাগুলো সাধারণ মানুষ কেন কতজন শিল্পী আত্মস্থ করতে পেরেছেন?