ভাষার প্রীতি, ভাষায় বিকৃতি
আহমাদ মোস্তফা কামাল
দেশ বা জাতীয়তা নয়, ধর্ম বা বর্ণও নয়, কেবলমাত্র ভাষাও যে মানুষের পরিচয়চিহ্ন হয়ে ওঠে, সেই
অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই কারো কারো হয়েছে। আমি নিজে অনেকবার এরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি,
তেমনই একটির কথা বলে লেখাটি শুরু করা যাক।
প্রায় দু’যুগ আগে কিছুদিনের জন্য ইতালিতে থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার। যে শহরে আমি থাকতাম–
ত্রিয়েস্তে– সেখানে বাঙালির দেখা প্রায় পাওয়াই যেত না। ইতালির প্রান্তবর্তী ওই শহরে হয়তো বাঙালিদের
জন্য তেমন কাজের সুবিধা না থাকায় এমনটি হয়ে থাকবে। বাঙালি না থাকায় বাংলায় কথা বলা বা বাংলা
শোনা আমার জন্য দুর্লভ হয়ে উঠলো। অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে দেশে ফোন করে বাংলা বলা বা শোনা
ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু সেটা তো আর নিয়মিত করা যেত না, সামর্থ্যরে একটা ব্যাপার তো ছিলই।
তখনও এতসব প্রযুক্ত আসেনি। দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয়েছে সীমিত পরিসরে, তাও বড় বড় কিছু
প্রতিষ্ঠানে, বাসা-বাড়িতে ইন্টারনেটের নামই শোনেনি কেউ। ইমেইল ছাড়া যোগাযোগের জন্য অন্য কোনো
নেট-মাধ্যম আবিস্কৃতও হয়নি। স্কাইপি, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদির জন্মও হয়নি
তখন। বিদেশ থেকে দেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য টের্লিফোন করা ছাড়া বিকল্প কিছু ছিল না,
ইন্টারনেটে বাংলায় লেখার কথা কল্পনাও করতাম না আমরা। হয়তো সেজন্যই দিনের পর দিন এরকম
বাংলাহীন থাকতে থাকতে আমি যেন বাংলার জন্য বুভুক্ষু হয়ে উঠলাম। মনে হতে লাগলো– একবার যদি
দেশে ফিরতে পারি, তাহলে জীবনে আর কোনোদিন বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলবো না!
সমুদ্র আর পাহাড় ঘেরা ত্রিয়েস্তে এমনিতে অসাধারণ সুন্দর শহর। একদা অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে
থাকা এই শহরের মানুষগুলোও যতটা না ইতালিয়ান তারচেয়ে বেশি অস্ট্রিয়ান। আন্তরিক ও অতিথিপরায়ন,
ইউরোপীয় বিচ্ছিন্নতা এখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু এই রূপসী শহর, এই আন্তরিক মানুষ,
অসামান্য রূপবতী তরুণীর দল, সমুদ্র, সমুদ্রতীরে টপলেস সুন্দরীদের ভ্রুক্ষেপহীন রৌদ্রস্নান, পাহাড়,
ডিসকো ক্লাব, জলের দামে পাওয়া যায় এমন বহু ধরনের পানীয়– এসবের কোনোকিছুই যেন আর আমাকে
টানছিল না। তো, এরকম একটি সময়ে এক মজার ঘটনা ঘটলো। ত্রিয়েস্তের পাশের শহর ভেনিসÑ পৃথিবীর
বিখ্যাত পর্যটন শহর। এক ছুটির সকালে ট্রেনে উঠে বসলাম ভেনিস দেখবো বলে– মাত্র দু-ঘণ্টার ভ্রমণ,
যাত্রীরা সবাই পর্যটক, কিন্তু কারো সঙ্গেই আলাপ জমাতে ইচ্ছা করলো না আমার। মনে হলো– একা একাই
ঘুরে বেড়াবো ভেনিস। অনেক গল্প শোনা ভেনিস অবশ্য প্রথম দেখায় আমাকে তেমন আকর্ষণ করতে
পারলো না। জলে ডোবা একটা শহর; প্রথম দেখায় বর্ষার জলে ডুবে যাওয়া বাংলাদেশের যে-কোনো গ্রামের
মতোই মনে হয়! এ আর এমন কী! এই সামান্য জল-ডোবা শহর দেখার জন্য সারা পৃথিবীর মানুষের এত
হাহাকার! তারচেয়ে তো আমার গ্রামই ভালো! তো, এসে যখন পড়েছি, একটু ঘুরে দেখা যাক– ভেবে টিকেট
কেটে ইঞ্জিন বোটে উঠে বসলাম। ইঞ্জিন বোট মানে আমাদের শ্যালো ইঞ্জিন-চালিত বড় নৌকার ভেনিসিয়
সংস্করণ, সুবিখ্যাত গন্ডোলাকে মনে হলো আমাদের বিল-হাওরে অহরহ চলতে দেখা কোষা নৌকার একটু
সৌখিন সংস্করণ! এভাবেই নিজের দেশের সঙ্গে অহরহ তুলনা এসে যাচ্ছিল, কোনোকিছুই মনোমুগ্ধকর
বলে মনে হচ্ছিল না! আমার অবস্থাটি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, প্রিয় পাঠক! দেশের জন্য তখন এতটাই
পাগল হয়ে আছি যে, বাংলাদেশের একখণ্ড মাটি আর ইতালির একখণ্ড স্বর্ণ এ দুটোর মধ্যে একটিকে বেছে
নিতে বললে আমি নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের একখণ্ড মাটিই নিতাম!
ঘটনাটি ওই ভেনিসেরই। জলে ডোবা শহর বলে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যেতে হয় বোট-এ করে।
সারাদিনই বোট চলছে, অসংখ্য পর্যটক, বিরাম নেই কোনো। আমিও একটা বোটে উঠে বসলাম আরো
অনেকের সঙ্গে। একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলাম সহযাত্রীদের ওপর– না, একজনও বাঙালি নেই! তবে
কিছু লোকের চেহারায় উপমহাদেশীয় ছাপ আছে বলে মনে হলো। চুপচাপ বসে বসে জলমগ্ন ভেনিস
দেখছি, আর দেশে ফেলে আসা বর্ষার কথা মনে পড়ে বুক হু হু করে উঠছে। ঠিক এরকমই একটা সময়ে
শুনলাম, আমার ঠিক পেছন থেকে একটি নারী কণ্ঠ বলে উঠলো– ‘এ্যাই ওটা তো খুঁজে পাচ্ছি না!’ অতি
সাধারণ এই বাক্যটি আমার সারা শরীরে শিহরণ বইয়ে দিলো। ঝট করে পেছন ফিরে দেখলাম এক মধ্যবয়সী
নারী– দেখে ঠিক বাঙালি মনে হয় না, মনে হয় ভারতীয় বা শ্রীলংকান– আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম– আপনি বাঙালি?
তিনি মধুর করে হাসলেন, বললেন– আমি ধারণা করেছিলাম, আপনিও বাঙালি, সেজন্যই কথাটা বাংলায়
বলেছি!
এতক্ষণ তাঁরা ইংরেজিতেই কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন বলে আমি তাঁদেরকে খেয়ালই করিনি! এবার পরিচয়
হলো। দীর্ঘকাল ধরে আমেরিকা প্রবাসী, গ্রীষ্মের ছুটিতে স্বামী-সন্তান নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন। সন্তানদের
খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে বললেন– ‘বাংলাদেশে থেকে এসেছেন, তোমাদের মামা।’ কিন্তু তাদের মধ্যে তেমন
কোনো সাড়া পড়লো না– তারা বাংলা ভালো করে জানে না, বোঝে না।
এই ঘটনাটি আমাকে খুব ভাবিয়েছে। ওই নারীর যখন মনে হয়েছিল, সামনে বসে থাকা অচেনা যাত্রীটি তাঁর
দেশী ভাই, তিনি সরাসরি সেটি জিজ্ঞেস না করে একটি বাংলা বাক্য বলে নিজের ধারণাকে যাচাই করে
নিয়েছিলেন। ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? দাঁড়াচ্ছে এই যে, মাতৃভাষা হচ্ছে সেই পরিচয়চিহ্ন যা সম্পূর্ণ
অপরিচিত দুজন মানুষকে অচেনা এক ভিনদেশে একটি মাত্র বাক্য/শব্দ দিয়ে পরস্পরকে একসূত্রে গেঁথে
দেয়! বিদেশে এই কথাটি খুব বেশি করে মনে হয়, দেশী মানুষ আর মাতৃভাষাকে মনে হয় মাতৃভূমির মতোই।
এমনকি বিমানবন্দরে গিয়ে বাংলাদেশ বিমানের কোনো উড়োজাহাজ চোখে পড়লেও চোখ জুড়িয়ে যায়!
যাহোক, ওখানে বেশিদিন টিকতে পারিনি। আনন্দের সব উপকরণই ছিল সেখানে, শুধু বাংলাদেশ নামক
দেশটি ছিল না, বাংলা ভাষা নামক ভাষাটি ছিল না! দেশে ফেরার সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, জীবনে আর
কোনোদিন বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলবো না! সেটি আর হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ হচ্ছে এমন
একটা দেশ, যে দেশে ‘শিক্ষিত’ মানুষ মানেই শেকড়-বিচ্ছিন্ন মানুষ। শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলেই
সমস্তকিছু থেকে দূরে সরে যায় তারা, এমনকি নিজের ভাষায় কথা বলতেও ‘কিঞ্চিৎ’ কুণ্ঠা বোধ করে!
বাঙালিই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল, আবার তাদেরই একটি অংশ
(শিক্ষিত অংশ) নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে! আমিও পুরোপুরিভাবে এর
বাইরে থাকতে পারিনি। মাঝে-মাঝে এমন কিছু আয়োজন-অনুষ্ঠানে যেতে হয় আমাকে, যেখানে ইংরেজিতে
কথা না বললে, বা বাংলা ব্যবহার করলে উপস্থিত সুধীজন করুণার দৃষ্টিতে তাকান! সেইসব চোখের দিকে
তাকিয়ে স্পষ্টই পড়ে নেয়া যায়, ওগুলো বলছে– আহারে লোকটা ইংরেজি জানে না! অবশ্য শুধু করুণা
থাকলেও মেনে নেয়া যেত, থাকে তাচ্ছিল্য। বাংলা বলা যেন অপরাধ, যেন এমন এক ভাষায় কথা বলছি যেটি
ভিন্ন কোনো গ্রহ থেকে এসেছে! কেউ তা বুঝতে পারছে না!
২
এরকম ঘটনা বোধহয় পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ঘটে না। নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় কোনো
জাতিই নিজ ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করে না। ফরাসী, জার্মানী, ইতালিয়ানরা তো রীতিমতো
ভাষার ব্যাপারে মৌলবাদী অবস্থান গ্রহণ করেছে। ওসব জায়গায় থাকতে হলে আপনাকে ওদের ভাষা শিখে
নিতেই হবে! জাপানিরাও বেশ কয়েকবছর ধরে একই অবস্থান নিয়েছে, চীনারা তো আগের থেকেই ওরকম।
ব্যক্তিগতভাবে তাদের এই অবস্থানকে আমি সমর্থন করি। নিজেদের ভাষার প্রতি ভালোবাসার বোধ থেকেই
তারা এরকম মৌলবাদী অবস্থান গ্রহণ করেছে। অবশ্য কেবলমাত্র ভাষা-প্রীতির কারণে না-ও হতে পারে,
হয়তো ইংরেজি ভাষার দৌরাত্ন্য কমানোর একটা উদ্দেশ্য তাদের থেকে থাকতে পারে। উদ্দেশ্য যা-ই হোক
না কেন, এই অবস্থানের কারণে তারা যে খুব একটা পিছিয়ে পড়েছে, তা তো নয়, বরং তাদের ভাষাটি
অধিকহারে চর্চিত হচ্ছে! অবশ্য ভারতের কথা একটু আলাদা। বহু জাতি-গোষ্ঠীর দেশ ভারত, তাদের
প্রত্যেকেরই নিজস্ব সমৃদ্ধ ভাষা আছে। ফলে একই দেশের নাগরিক হলেও তারা একই জাতির নয়, ভাষাও
এক নয়। আর তাই বাধ্য হয়েই এক জাতির লোক অন্য জাতির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ইংরেজি বা হিন্দি
ব্যবহার করে। কিন্তু বাংলাদেশ তো প্রায় পুরোপুরিই সমজাতির-সমভাষার দেশ। এমনকি আদিবাসীদের
নিজস্ব ভাষা থাকা সত্ত্বেও তারা বাঙালিদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বাংলাই ব্যবহার করে। তারা যদি
ইংরেজি ব্যবহার করতো সেটা অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত হতো। নিজ জাতির বাইরে অন্য কারো সঙ্গে কথা বলার
জন্য আমি তৃতীয় কোনো ভাষা ব্যবহারই করতে চাইবো। তো, যেহেতু বাংলাদেশে এই সমস্যা নেই, বাংলায়
কথা বললে যেহেতু সারাদেশের মানুষের সঙ্গেই সহজ-যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব, তাহলে নিজেদের মধ্যে কথা
বলার সময় ইংরেজি ব্যবহার করবো কেন? আমার এই লেখা পড়ে পাঠকরা যেন মনে না করেন, আমি
ইংরেজি শিক্ষার বিপক্ষে অবস্থান করছি। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে এটি শিখতে হবে, চর্চাও করতে হবে,
কিন্তু তাই বলে নিজের ভাই-বোন-বন্ধুর সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলবো কেন? তাছাড়া, ‘জাতীয় উন্নয়নের
জন্য ইংরেজি’ ধরনের চিন্তাভাবনা যে পুরোটাই ভুলে ভরা সেটা তো ওপরের যে দেশগুলোর কথা বলেছি,
তাদের দেখেই বোঝা যায়। উন্নয়নের জন্য বিদেশী ভাষা শিক্ষার যুক্তিটি হাস্যকর, এই দুটো বিষয় পরস্পর
সম্পর্কযুক্ত নয়, বরং ভাষা-শিক্ষাকে জ্ঞান অর্জনের একটা মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করাটাই অধিকতর
যুক্তিসঙ্গত।
সমস্যাটা, আমার মনে হয়, অন্য জায়গায়। বাংলা অনাদিকাল থেকেই গরীবের ভাষা। এদেশের
চাষাভুষাশ্রমিককৃষক সবাই বাংলায় কথা বলে। নব্য শিক্ষিতরা, বিশেষ করে নব্য ধনীরা, নিজেদেরকে ওই
‘গরীব’দের থেকে আলাদা করার জন্যই ইংরেজিতে দাখিল হন! গণতান্ত্রিক দেশ, এ বিষয়ে কারো কিছু
বলারও নেই। যার যেমন ইচ্ছে আর কি! কিন্তু এ কথা ভুলে গেলে চলবে কেন, যে, বিষয়টি শুধুমাত্র অধিকার
চর্চার নয়, আইন-আদালতের বিষয়ও এটি নয়, বিষয়টি আসলে নৈতিকতার। জাতীয় পরিচয়ের অন্যতম
উপাদান ভাষা– সেটি ভুলে যাওয়া বা ভুলে যাওয়ার ভান করা আসলে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করারই
সামিল।
৩
যদি মেনেও নিই যে, কিছু লোক মাতৃভাষায় কথা বলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করবে না, তারা ইংরেজিতেই বলুক,
তবু কথা শেষ হয় না। এ দেশে বাস করার সুবাদে তাদেরকে কখনো-না-কখনো বাংলা বলতেই হবে। যেমন,
জার্মানিতে বসবাস করতে হলে তাদেরকে জার্মান ভাষার ব্যবহার জানতেই হবে। তো, এরকম পরিস্থিতিতে
বাংলা বলার সময় যে বিকৃত উচ্চারণ তাদের মুখে শোনা যায়, সেটি তো সহ্য করার মতো নয়! আর এই
বিকৃত উচ্চারণকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, বিস্ময়করভাবে, কিছু মিডিয়া– বিশেষ করে এফএম রেডিও
চ্যানেলগুলো এবং কিছু প্রাইভেট টেলিভিশন স্টেশন।
এফএম রেডিওর উপস্থাপকরা, যাদেরকে আবার ডাকা হয় রেডিও জকি বা আরজে বলে, কেমন ভাষায়
উপস্থাপন করেন, অর্থাৎ তাদের উপস্থাপিত ভাষাভঙ্গিটি কীরকম তার একটা উদাহরণ দিচ্ছি–
‘হাই ডিয়ার লিসেনাড়স এখন আমড়া ফর আ হোয়াইল ব্রেকে চলে যাচ্ছি কাড়ণ মাগড়েবের আযানেড়
টাইম হয়ে গেছে আর জানেন তো এই ড়মজানে মাগড়েব মিনস ইফটাড়ি মানেই হলো ফ্যাসিনেটিং সব
খাবাড়দাবাড়। সো এখন কোড়ান তেলাওয়াত হবে লেটস টেক আ ব্রেক ব্রেকের পড় ফিড়ে আসবো মজাড়
মজাড় ড়কিং হট সব গান নিয়ে।’ আউযুবিল্লা হি মিনাশশায়তান… (তেলাওয়াত শুরু হয়ে গেছে)…
ভাবছেন, এতসব ভুল বানান সমৃদ্ধ লেখাটি আমি লিখলাম কীভাবে? না, প্রিয় পাঠক, ভুল আমি করিনি,
কানে যেমনটি শোনা গেছে তেমনটিই লিখেছি। বুদ্ধি করে অংশটুকু লিখে রেখেছিলেন অনুজপ্রতিম
ব্লগার-লেখক রিয়াজ শাহেদ। আমি সেখান থেকে ধার করে হুবহু উদ্ধৃতি করলাম। ভাবছেন, বানান ভুল না
হয় মেনে নেয়া গেল, কিন্তু দাড়ি কমা সেমিকোলনের বালাই নেই কেন এই লেখায়! এই প্রশ্নেরও ওই একই
উত্তর! যেমনটি শোনা, তেমনটিই লেখা। যারা শখ করে বা বাধ্য হয়ে বা সময় কাটানোর জন্য এফএম রেডিও
শুনে থাকেন, তারা নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে এই বিষয়ে একমত হবেন যে, ‘আরজে’দের উপস্থাপনার মধ্যে
কোনো দাড়িকমাসেমিকোলনের বালাই নেই, নেই প্রশ্ন বা বিস্ময়বোধক চিহ্নের ব্যবহার। তারা এক কিম্ভুত
উচ্চারণে কথাগুলো টানা বলে যেতে থাকেন, কোন কথাটা যে কোন বাক্যের অংশ সেটি রীতিমতো মাথা
খাটিয়ে বের করতে হয়! অবশ্য অতো মাথা খাটানোর কষ্ট বোধহয় শ্রোতারা করেন না। কেউ হয়তো
ব্যাপারটা পুরোপুরি উপেক্ষা করেন, কেউ বা নকল করার চেষ্টা করেন। এই দ্বিতীয় দলের সদস্যরা সবাই
তরুণ, যাদেরকে আদর করে বলা হচ্ছে ডিজুস জেনারেশন! আর এদের মধ্যে আজকাল এমন অনেক
তরুণ-তরুণীদের দেখা মেলে যারা বাংলা ভাষার অনেক শব্দ ঠিক মতো উচ্চারণই করতে পারে না। ‘ছ’ কে
‘স’ কিংবা ‘র’ কে ‘ড়’ উচ্চারণ করা তাদের প্রিয় অভ্যাস। টেলিভিশন খুললে, এফএম রেডিও খুললে,
এমনকি তরুণদের আড্ডায় একটু কান পাতলেই ব্যাপারটা টের পাওয়া যায়। তাদের এই উচ্চারণ রীতিমতো
ধ্বনি-বিপর্যয় বলেই মনে হবে যে কারো কাছে। বাংলা ভাষার যে অসামান্য ধ্বনি-মাধুর্য, সেটি অন্য কোনো
ভাষায় আছে কিনা সন্দেহ, এই তরুণরা সেটির খোঁজই রাখে না, রাখে না বলেই এই ধ্বনি-বিপর্যয়ে তারা
গৌরব বোধ করে। শুধু তাই নয়, একটি পূর্ণাঙ্গ বাংলা বাক্যও তারা বলতে চায় না, একটি বাক্যের অর্ধেক
বাংলায় বলে তো অর্ধেক বলে ইংরেজিতে। এই ঘটনাটি ঘটেছে প্রধানত ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা
উচ্চবিত্ত তরুণ-তরুণীদের কল্যাণে। তাদের প্রভাবে মধ্যবিত্ত তরুণরাও, যারা হয়তো বাংলা মাধ্যমেই
পড়াশোনা করেছে, এইভাবে কথা বলাকে গৌরবজনক বলে মনে করে। আর এই নেতিবাচক মনোভাবকে
আরো বেশি উস্কে দিচ্ছে এফএম রেডিও নামক বিচিত্র মিডিয়াগুলো। শুধু এফএম রেডিওর কথাই বা বলি
কেন? টেলিভিশনের অনেক অনুষ্ঠানেও তো একইরকম ঘটনা ঘটে চলেছে! তুলনামূলক তরুণ উপস্থাপকরা
‘প্রিয় দর্শক’ শব্দগুচ্ছ ভুলেই গেছে যেন বা, ‘ডিয়ার ভিউয়ার্স’ বা ‘ভিউয়ার্সই’ তাদের প্রিয় শব্দ। তারা
অনুষ্ঠানের মাঝখানে আর বিরতি নেয় না, নেয় ব্রেক! এসএমএস পাঠানোর অনুরোধে সবসময় বলা হয়
অমুক নম্বরে ‘সেন্ড’ করুন, যেন ‘পাঠিয়ে দিন’ বললে তাদের ‘ভিউয়ার্স’ বুঝতে পারবে না! এরকম
উদাহরণ প্রচুর দেয়া যায়। শুধু এসব অনুষ্ঠানই নয়, গত প্রায় একদশক ধরে একদল টেলিনাট্য
লেখক-পরিচালক প্রমিত ভাষার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন। তাদের নাটকের পাত্রপাত্রীরা প্রমিত ভাষায় কথা
বলাটাকে প্রায় হাস্যকর ব্যাপার বলেই মনে করে! এই নব্য ভাষা সৈনিকগণ তাদের এই কর্মকা-ের সপক্ষে
যুক্তি হিসেবে যে কথাটি সবচেয়ে বেশি বলে থাকেন, তা হলো– ‘আমরা’ যে ভাষায় কথা বলি, সেই ভাষায়ই
সংলাপ বলি/বলাই! কিন্তু তারা কখনোই বলেন না, এই ‘আমরা’ বলতে তারা কাদেরকে বোঝাচ্ছেন!
সারাদেশের দর্শক? শুধু ঢাকার দর্শক? নাকি কেবলমাত্র এই ভাষা সৈনিকগণ এবং তাদের পরিবার পরিজন?
সারাদেশের মানুষ যে ওই ভাষায় কথা বলে না, সেটা তো আর প্রমাণ করে দেখানোর প্রয়োজন পড়ে না।
একেক অঞ্চলের মানুষ তাদের নিত্যদিনের ভাষা ব্যবহারে আঞ্চলিক ভাষটিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন! এবং,
বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্য অঞ্চলের কারো সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তারা প্রমিত ভাষাটিকেই ব্যবহার
করেন। এমনকি ঢাকায় বসবাসরত মানুষরাও তো ওই ভাষা ব্যবহার করেন না। যদি ধরেই নিই, এটি
ঢাকাবাসীর নিত্যদিনের ব্যবহৃত ভাষা, তবু প্রশ্ন থেকে যায়– এটা কোন অর্থে ঢাকার ভাষা? কোন ঢাকার
ভাষা? ঢাকার কোন জনগোষ্ঠীর ভাষা? এটা কি ঢাকার ১৫% মধ্যবিত্তের ভাষা, নাকি ৫% উচ্চবিত্তের, নাকি
৮০% নিম্নবিত্তের? ঢাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ কি এই ভাষায় কথা বলে, পরস্পরের সঙ্গে এই ভাষায়
যোগাযোগ করে? তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই যে, এটা মধ্যবিত্তের ভাষা, তাহলে ঢাকার ৮৫ ভাগ
লোককেই যে তারা তাদের ভাষা-আওতার বাইরে রাখছেন, এবং নিজেদের ভাষাটাকে তাদের ওপর চাপিয়ে
দিতে চাইছেন (দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম), এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা
যায়? সেক্ষেত্রে ব্যাপারটাকে তো রীতিমতো ১৫ ভাগ সুবিধাভোগী মধ্যবিত্তের সাম্প্রদায়িক আচরণ বলে
চিহ্নিত করতে হয়! নব্য ‘ভাষা-সৈনিকদের’ মধ্যে এরকম সাম্প্রদায়িকতা আছে নাকি? আর এটাকে
মধ্যবিত্তের ভাষাই বা বলি কীভাবে? মধ্যবিত্তরা কি এই ভাষায় কথা বলে? ‘ভাষা-সৈনিকগণ’ও কি ব্যক্তিগত
জীবনে এই ভাষায় কথা বলেন? মনে তো হয় না! ঢাকার মতো একটা মেগাসিটির (যেখানে প্রায় দেড়কোটি
লোকের বসবাস, যাদের অধিকাংশই বহিরাগত এবং অস্থায়ী বাসিন্দা- সুযোগ পেলেই বা কাজ ফুরালেই যারা
তাদের ‘দেশের’ দিকে ছুট দেয়) কোনো নিজস্ব ভাষা থাকে না, থাকতে পারে না। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল
থেকে এখানে যারা আসে, তারা তাদের ভাষাটিকেও সঙ্গে নিয়ে আসে এবং ফিরে যাবার সময় ওটা নিয়েই
ফেরে। এসব কথা বলে অবশ্য কোনো লাভ নেই, এই ধরনের যুক্তিবোধ যদি তাদের থাকতোই, তাহলে তো
এমন ঘটনা তারা ঘটাতেনই না!
প্রতিটি ভাষাতেই প্রমিত বা মান ভাষা বলে একটা ব্যাপার থাকে। কেন থাকে? কারণ, এটা সর্বজনস্বীকৃত
ব্যাপার যে, দৈনন্দিন জীবনে যে ভাষা মানুষ ব্যবহার করে, সেটি দিয়ে যেমন দাফতরিক বা আনুষ্ঠানিক
কাজকর্ম চালানো সম্ভব নয়, তেমনি সেটির মাধ্যমে একটি দেশের সব অঞ্চলের সব শ্রেণিপেশার মানুষের
সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপনও সম্ভব নয়। আঞ্চলিক ভাষা বলতে যে একটা ব্যাপার আছে, সেটি ভুলে
গেলে চলবে কেন? প্রতিটি অঞ্চলের মানুষ তাদের নিজ অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের
নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে। কিন্তু সেটি অন্য অঞ্চলের মানুষের কাছে বোধগম্য বা গ্রহণযোগ্য
না-ও হতে পারে। ফলে একটি মান ভাষার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মিডিয়া (প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক) বা বইয়ের
সম্ভাব্য ভোক্তা যেহেতু সারাদেশের মানুষই, সেজন্যই এসব মাধ্যমে ব্যবহৃত ভাষাটি মানভাষা হওয়াই
যুক্তিসঙ্গত। গল্প-উপন্যাস বা নাটকে সংলাপের প্রয়োজনে আঞ্চলিক ভাষা আসতে পারে, সেটি অবশ্যই
গ্রহণযোগ্য, কিন্তু বর্ণনার ভাষাটি প্রমিত হওয়াই বাঞ্চনীয়। কিন্তু এসব কথা তাদেরকে বোঝোবে কে?
৪
অবশ্য শুধুমাত্র কিছু অনুষ্ঠান আর কয়েকজন নাট্যকারের নাটকের কথা বললেই বিষয়টি শেষ হয়ে যায়
না। বাংলাদেশে বেসরকারী টেলিভিশন আসার পর সংবাদ-প্রচারে যে জোয়ার এসেছে, সেখানে
সংবাদকর্মীরা একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। কিন্তু দুঃখজনক হল্ওে সত্যি, রিপোর্টারদের এক বড়ো
অংশেরই শুদ্ধ উচ্চারণ সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই। অনেকের উচ্চারণেই আঞ্চলিক টান, অনেকেই কোন
বাংলা বর্ণটির উচ্চারণ কেমন সেটি জানেন না। আর এসব ভুলভাল ত্রুটিপূর্ণ উচ্চারণের প্রভাব পড়ছে
তরুণ প্রজন্মের ওপর। বাংলা বর্ণমালা প্রধানত ধ্বনিভিত্তিক বর্ণমালা। আমার জানামতে, বাংলার মতো
ধ্বনিমাধুর্য পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় নেই। অথচ এখনকার তরুণ-তরুণীরা এফএম রেডিও আর
স্যাটেলাইট টেলিভিশনের প্রভাবে এমন বিকৃতভাবে বাংলা শব্দগুলোকে উচ্চারণ করে যে, এটাকে
ধ্বনি-বিপর্যয় ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না!
প্রশ্ন হচ্ছে, গণমাধ্যমগুলো কেন এই ধরনের বিকৃত উচ্চারণ অনুমোদন করছে? তাদের তরুণ
উপস্থাপকদেরকে কেন তারা বলছে না যে, হয় বিশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে অথবা বিশুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণে
উপস্থাপন করতে হবে? আরেকটি কথা, ভুল উচ্চারণ যে কোনো গৌরবের বিষয় নয়, বরং নিতান্তই লজ্জার
বিষয়, এবং ভাষা-ব্যবহারে অক্ষমতার এবং দূর্বলতার লক্ষণ এই ব্যাপারটি কেন তাদের কেউ বুঝিয়ে বলছে
না? তাদের পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কি এই দায়িত্বটুকু পালন করতে পারে না? এই তরুণরা তো জানে না,
যে, যে ভালো বাংলা বলতে পারে একমাত্র সে-ই শিখে নিলে ভালো ইংরেজি বলতে পারবে, কারণ ভাষা
ব্যবহারের মূল সূত্রগুলো মোটামুটি একইরকম। এর যে-কোনো একটিতে ভুল করা মানে অন্যটিতেও সে
ভুল করছে!
জানি না, ভাষার এই বিকৃতি আর অপব্যবহারের শেষ কোথায়! তবে নিশ্চয়ই এটুকু আশা আমরা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমগুলোর কাছে করতে পারি যে, ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকেই তারা তাদের
শিক্ষার্থীদেরকে শুদ্ধভাবে ভাষা ব্যবহারের জন্য উৎসাহী করে তুলবেন।