হাস্যরসিক বঙ্গবন্ধু

রাজনীতিতে আলাপচারিতা নিত্যকর্ম। এই কর্মের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে আলাপচারী
কতটা বাচস্পতি তার উপর। আর এখানেই বঙ্গবন্ধু অনন্য, অতুল্য। যুক্তি উপস্থাপনে
তিনি এতটাই পারঙ্গম ছিলেন যে প্রতিপক্ষ অনেক সময় হতোদ্যম হয়ে পড়তেন। কিন্তু
সেখানে হঠকারী মনোভাব প্রকাশ পেত না। উচ্চরুচিসম্পন্ন দীপ্তি ও দ্রুতি গুণে মার্জিত,
দীপ্র আলাপচারী বঙ্গবন্ধুর কথাই এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। এবং এরই ফাঁকে যে গুণ
হীরক দ্যুতির ন্যায় ঝলকে উঠতো তা হলো কৌতুক হাস্যরস।
১৯৭২ সালের কথা, সবে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা চালু হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রীদের
দপ্তর তখনও বণ্টন হয়নি। এ নিয়ে এবিএম মূসা কৌতূহল প্রকাশ করায় বঙ্গবন্ধু
কৃত্রিম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, ‘সব এখন বলবো না। একটু পরেই জানতে পারবা।
উপযুক্ত ব্যক্তিকেই যথাযথ দায়িত্ব দিয়েছি। তবে একটা দপ্তর নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম।
অনেক ভেবেচিন্তে সেটা জহুরের (আহমদ চৌধুরী) কাঁধে চাপালাম। দপ্তরটি হচ্ছে স্বাস্থ্য
ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ। ভেবে দেখলাম, আমার মতো সারা জীবন জেল খাইটা তার শরীরডা
খ্যাংরা কাঠির মতো হইয়া গেছে। সব ডাক্তারকে সে মাইনষের স্বাস্থ্য ভালো করার
তাগিদ দিতে পারব। সে আবার দুই বউয়ের ১৪টি বাচ্চা নিয়া হিমশিম খাইতাছে।
বেশি বাচ্চা হওয়ার জ্বালাও সে বোঝে। তাই তারে জন্ম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিছি।’

সহজাত রসিকতায় বঙ্গবন্ধুর হাসি অক্লাক্ত, নির্ভার, নিঃশঙ্ক। কর্মে একাগ্রতা, দায়িত্বে
নিষ্ঠা, ভয়—ডরহীন মনোভাব, সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। দলের
কর্মীদের প্রতি ছিল নিখাঁদ ভালোবাসা। নেতার চেয়ে কর্মীদের বন্ধু হতেই বেশি
ভালোবাসতেন। তাঁর স্বভাবসুলভ স্মিত হাসিতে কখনও কেটে যেত অভিমানের মেঘ,
কখনও ঝরত স্নেহসুধা। বুদ্ধিদীপ্ত হাসির ঝিলিকে কখনও মিলত প্রশ্রয়ের ইঙ্গিত, কখনও
ধরা পরত সূক্ষ্ম কৌতুক।
একদিন গণভবনে সান্ধ্য আসর বেশ জমে উঠেছে। এমন সময় তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এসে
উপস্থিত। তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘নেতা, গাফ্্ফার আমার সম্পর্কে কী লিখেছে
দেখেছেন? লিখেছে, আমি নাকি সরাইলের কুকুর।’
বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন ঘটনা কী? জানা গেল আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী তখন ‘দৈনিক
জনপদ’—এর সম্পাদক। তাহের ঠাকুর সেই পত্রিকার সরকারি বিজ্ঞাপন কমিয়ে দেয়ায়
গাফ্্ফার চৌধুরী তথ্য মন্ত্রণালয়ের কড়া সমালোচনা করে প্রতিমন্ত্রীকে ‘সরাইলের সারমেয়’
লিখেছে। প্রতিমন্ত্রী তাহের ঠাকুরের আদি বাড়ি সরাইল। ফলে তার সম্মানে ঘা
লেগেছে।
নালিশ শুনে বঙ্গবন্ধু গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর গাফ্্ফার চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ভারী
গলায় বললেন, ‘অন্যায় করেছ! তাহেরকে সরাইলের কুকুর বলা ঠিক হয়নি। জানো
কত প্রজাতির কুকুর আছে?’

এরপর তিনি নিজেই সেই ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলেন— ‘বিলেতি মেম সাহেবরা কোলে
বসিয়ে ল্যাপডগকে আদর করে। অস্ট্রেলিয়ায় রাখালেরা ভেড়ার পাল সামলায় শেফার্ড
কুকুর লেলিয়ে দিয়ে। ইউরোপে অ্যালসেসিয়ান কুকুর বাড়ি পাহারা দেয়। দুর্ধর্ষ এসব
অ্যালসেসিয়ান অনেকটা সরাইলের কুকুরের মতো দেখতে, পাতলা লম্বা ভয়ঙ্কর—দর্শন।’
বঙ্গবন্ধু একটু থেমে গাফ্্ফার চৌধুরীকে বললেন, ‘আমার ভজহরির মতো এমন
ঘাড়ে—গর্দানে নাদুসনুদুস ফর্সা, তবে হ্যাঁ, রাগলে লালমুখো হয়ে যায়, এক ধরনের
কুকুরও আছে বৈকি। সেগুলো হলো বুলডগ, লালমুখো, মোটাতাজা শরীর।’
এরপর তিনি আড়চোখে সুদর্শন, নাদুসনুদুস তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি
ভরা গলায় বললেন, ‘গাফ্্ফার, খবরদার এরপর কারো চেহারাসুরত নিয়ে ঠাট্টা করবা
না।’
কথা শুনে উপস্থিত সবাই মাথা নিচু করে হাসি সামলানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মাথা
তোলার পর সেখানে আর লালমুখো ঠাকুরমশাইকে দেখা গেল না। তিনি ততক্ষণে
পালিয়ে বেঁচেছেন।
বঙ্গবন্ধু তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে এখানে ‘ভজহরি’ বলছেন। খোলা মনের মানুষ না হলে
নিকটজনকে নিয়ে এমন রসিকতা সম্ভব নয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম নিয়ে রসিকতা করার ঝেঁাক ছিল। কাছাকাছি যারা থাকতেন
প্রায়ই তাদের নতুন নামকরণ করতেন। যেমন সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর মাথায় বিরাট টাক
দেখে কখনও ডাকতেন ‘বলডুইন’, কখনও ‘সুধাসমুদ্র’। সচ্চিদানন্দ রায়কে বলতেন
‘আলু’।
কাজী নজরুল ইসলামও সুরসিক ছিলেন। তিনি আফ্জালুল হককে ডাকতেন ‘ডাবজল’,
মোতাহার হোসেনকে ‘মোতিহার’, হায়দারকে ‘হাইদর’, সজনীকান্ত দাসকে বলতেন ‘সজনে
ঘণ্ট খাস’, আকরাম খাঁকে ‘বাগরম খাঁ’। কি তার নামের বাহার! যারা শুনত তারা
হেসে কুটিকুটি হতো!
এখানে, এই দুই কবির সঙ্গে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের আশ্চর্য
এক মিল রয়েছে। তিন সাংবাদিক বন্ধুকে বঙ্গবন্ধু নাম দিয়েছিলেনÑ আপদ, বিপদ এবং
মুসিবত। ফয়েজ আহমদকে তিনি ডাকতেন ‘আপদ’, এবিএম মূসাকে ‘বিপদ’ এবং
আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরীকে ডাকতেন ‘মুসিবত’ নামে। এই হলো তাঁর আদরের ডাক!
বাগ্মিতা দক্ষ রাজনীতিকের অন্যতম গুণ। শুরুতেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
এই অসামান্য গুণের অধিকারী ছিলেন। তুখোড় বক্তা হিসেবেই নয়, দ্বি—পাক্ষিক
আলোচনাতেও তার জুড়ি মেলা ভার! প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডনে অনেক সময় তিনি যেমন
প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি রসিকতা করতেও ছাড়েননি।
১৯৬৯—এর উত্তাল সময়। আইয়ুব খানের প্রস্তাবিত গোল টেবিল বৈঠক বয়কট করলেন
জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং মওলানা ভাসানী। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অটল। তিনি বৈঠকে যোগ
দিবেন। উত্তপ্ত রাজনীতির সূক্ষ্ম মারপ্যঁাচে কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে শুরু হয়ে গেছে
তার হিসাবনিকাষ।
মওলানা বললেন, ‘মুজিবর মিয়া, তুমি আরটিসিতে (গোল টেবিল বৈঠক) যাইও না।’
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘হুজুর আমি তো কথা দিছি। মামলা উঠাইয়া নিলে রাওয়ালপিণ্ডি যামু।’
‘ভুট্টো যাইব না। আমিও বয়কট করছি।’ মওলানা এবার বুঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘তুমি
না গেলেই আরটিসি শ্যাষ।’

‘তবুও ওয়াদা রাখতে দোষ কি?’ বঙ্গবন্ধু তখনও নাছোড়বান্দা।
‘মুজিবর মিয়া, রাওয়ালপিণ্ডি যাইয়া তুমি আরটিসি ভাঙবা ক্যামনে?’
‘আমি ছয় দফার সবকিছু— দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন দুই হাতে জাবড়াইয়া রাখুম।
হুজুর, তাহলেই তো গোল টেবিল শ্যাষ!’
‘আর পিণ্ডি যাইয়া লাভ আছে?’ মওলানা শেষ যুক্তি শোনালেন, ‘প্রেসিডেন্ট আইয়ুব তো
এখন মরা লাশ!’
মুচকি হেসে বঙ্গবন্ধু পাল্টা যুক্তি দিলেন, ‘হুজুর, হেই মরা লাশের জানাজা পড়তে
দোষটা কি?’
এই হলো বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক রসবোধ। বলাবাহুল্য বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীর দোয়া নিয়েই
বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। এবং ছয় দফা দাবি থেকে এক চুলও সরে আসেননি।
ফলে বৈঠক এমনিতেই ভেস্তে গিয়েছিল। মাঝখান থেকে বঙ্গবন্ধু তার ওয়াদা রক্ষা
করতে পেরেছিলেন। একেই বলে সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না।
বঙ্গবন্ধু যে শুধু দেশ ও দশের কথা ভেবেছেন তা তো নয়। অতি সাধারণ ছিল
তাঁর জীবনযাপন। তাঁর পোশাক, আহার সবকিছুতেই ছিল খাঁটি বাঙালিয়ানা।
একবার আলজেরিয়া যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গীদের কাছে ফরেন অফিস থেকে চিঠি
এলো— আপনারা লুঙ্গি এবং মেসওয়াক নিতে পারবেন না। কিন্তু আবদুল গাফ্্ফার
চৌধুরী লুঙ্গি ছাড়া ঘুমাতে পারেন না। তাহলে উপায়? তিনি ছুটলেন বঙ্গবন্ধুর
কাছে। সব শুনে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আরে নিবি নিবি। আমিও কি লুঙ্গিছাড়া ঘুমাইতে
পারি নাকি। আমিও তো লুঙ্গি নিমু’
গাফ্্ফার চৌধুরী সেবার বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি আলজেরিয়া গিয়ে দেখলেন,
বঙ্গবন্ধু সত্যি সত্যি লুঙ্গি নিয়ে গিয়েছেন এবং হোটেলে লুঙ্গি পরেই আছেন।
আরেকবার ১৯৭২ সালে প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গেছেন বঙ্গবন্ধু। মস্কোতে
তাঁর আবাসস্থল ক্রেমলিন। পরাক্রমশালী জারদের এই আবাসস্থল আসলে ৩১টি প্রাসাদের
সমষ্টি। একেবারে রাজকীয় ব্যাপার। সমস্যা একটাইÑ প্রতিবেলা পোলাও কোরমা। এমনকি
সকালেও! সঙ্গে ক্যাভিয়ার, টোস্ট, ডিম, কাটলেটÑ মহা আয়োজন।
বঙ্গবন্ধু একদিন সাগ্রহে জানতে চাইলেন, ‘এরা প্রতি বেলা পোলাও—কোরমা দেয় কেন?’
সফরসঙ্গী ফারুক চৌধুরী বললেন, ‘স্যার, আমার ধারণা, এটা বাংলাদেশের সোভিয়েত
রাষ্ট্রদূত পপভের কীর্তি। তিনি নিশ্চয়ই এদের বলেছেন, এরা বাঙালি, ভাত—তরকারি খুব
ভালোবাসে। মস্কোতে এই পোলাও—কোরমা সম্ভবত ভাত—তরকারির রূপান্তর। ’
বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে বললেন, ‘ভাগ্যিস পপভ পান্তা ভাতের খবর পাননি। তাহলে তো
রাতেও খেতে হতো পান্তা ভাতের রূপান্তর!’
বঙ্গবন্ধুর কৌতুক প্রবণতায় মিশে আছে সারল্য এবং গভীর দেশপ্রেম। কেবল
আলাপচারিতায় নয়, মুজিবসাহিত্যের ধমনি শিরা—উপশিরায় প্রবাহিত হয়েছে সূক্ষ্ম হাস্যরস।
সতর্কভাবে পাঠ করলে, অšর্Íদৃষ্টি দিয়ে অনুভবের পরেই কেবল সেই অতুল্য ঝরনাধারার
সন্ধান মেলে। বিদগ্ধ পাঠকের এ এক অবাক অবগাহন!
‘আমার দেখা নয়াচীন’ থেকে উদাহরণ দেয়া যাক। ১ অক্টোবর নয়াচীনের স্বাধীনতা
দিবস পালিত হচ্ছে। শুরু হলো শোভাযাত্রা। পুরো পাঁচ ঘণ্টার শোভাযাত্রা শেষে
আলোচনা শুরু হলো লোকসংখ্যা কত হতে পারে?

কেউ বললো ৫০ লক্ষ, কেউ বললো ৪০ লক্ষ, বঙ্গবন্ধু বললেন, ১৫ লক্ষ। শুনে
উপস্থিত সবাই ক্ষেপে উঠলেন। আতাউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘আপনার কোনো ধারণাই নেই!’
পরের ঘটনা বঙ্গবন্ধুর জবানীতেই শোনা যাক। তিনি লিখেছেন: ‘যাহা হোক, কাল
সকালে দেখা যাবে— খবরের কাগজে কত লেখা হয়! আমাদের দেশের অভ্যাস, সরকারি
কাগজে যদি এক লক্ষ লেখা হয় তবে আমরা ধরে নিব ২৫ হাজার। … ভাবলাম,
এদেশে সরকারি কাগজগুলোও বোধহয় একই রকম। আর কম্যুনিস্টরা তো একটু
বাড়াবাড়ি করেই থাকে। পাঁচ হলে পঞ্চাশ করা তাদের অভ্যাস!
সকালে উঠে দেখি হায় হায়! কম্যুনিস্ট দেশের সরকারি কাগজ সত্য কথা লেখে!
একটু আশ্চর্য হয়ে গেলাম। লিখেছে ৫ লক্ষ লোকের শোভাযাত্রা। কোথায় আমরা বলি
২৫ লক্ষ! আর সরকারি কাগজ লেখে ৫ লক্ষ। আশ্চর্য হলাম। মিছাই কি এ দেশের
জনসাধারণ সরকারকে ভালোবাসে?’

তথ্যসূত্র:
কারাগারের রোজনামচা: শেখ মুজিবুর রহমান
আমার দেখা নয়াচীন: শেখ মুজিবুর রহমান
মহাপুরুষ: এম আর আখতার মুকুল
জীবনের বালুকাবেলায়: ফারুক চৌধুরী
মুজিব ভাই: এবিএম মূসা

ৎিরঃবৎ.বফরঃড়ৎ.এঙথঞঙথঞঙচৎিরঃবৎ.বফরঃড়ৎ.এঙথঞঙথইঙঞঞঙগ

Scroll to Top