আলফ্রেড হিচকক ও সত্যজিৎ রায়ঃ তুলনামূলক কথাবার্তা
পঞ্চাশ বছর ধরে প্রায় একনাগাড়ে একই ধরনের ছবি করে হিচকক যেভাবে নিজের খ্যাতি অটুট রেখেছিলেন এবং সেইসঙ্গে সিনেমার কলা-কৌশল নখদর্পণে এনেছিলেন, তার নজির চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নেই বললেই চলে’— বলেছিলেন আর এক বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়।
সময়ের হিসেবে আলফ্রেড হিচকক(১৮৯৯-১৯৮০)-এর চাইতে বাইশ বছরের ছোট ছিলেন সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২)। হিচকক সিনেমা বিষয়ক কাজ শুরু করেছিলেন ১৯১৯ সালে, ফেমাস প্লেয়ার্স-ল্যাস্কি ব্রিটিশ প্রোডিউসার্স লিমিটেড সংস্থায় যোগ দিয়ে। সত্যজিৎ জন্মেছেন তারও দু-বছর পরে। আর যখন হিচকক নিজে প্রথম ছবি পরিচালনা করেছেন তখন সত্যজিতের বয়স মাত্র চার বছর। ব
বাইশ বছর বয়সি সত্যজিৎ রায় যখন কর্মজীবন শুরু করলেন ডি জে কিমার-এর বিজ্ঞাপন সংস্থায় আশি টাকা মাসিক বেতনে, তখন ১৯৪৩ সাল। ততদিনে হিচকক ইংল্যান্ডের পাট চুকিয়ে পাকাপাকিভাবে হলিউডে গিয়ে রীতিমতো জাঁকিয়ে ছবি তৈরি করা শুরু করে দিয়েছেন। সেই বছর মু্ক্তি পেয়েছে ‘শ্যাডো অব আ ডাউট’ (১৯৪৩) ছবিটি। আমেরিকায় আসার পর সেটা ছিল তাঁর ষষ্ঠ সবাক ছায়াছবি।
আর সত্যজিতের মাথায় যখন চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়টি গেঁথে গিয়ে পরিপক্কতা পাচ্ছে ১৯৫০ সালে ফরাসি পরিচালক জঁ রেনোয়া (১৮৯৪-১৯৭৯)-এর সঙ্গে সাক্ষাতে এবং পরের বছর লন্ডন গিয়ে বিস্তর বিদেশে ছবি দেখতে পাওয়ার সুযোগে, সেই সময়ে হলিউডে হিচকক নির্মাণ করছেন ‘স্ট্রেঞ্জার্স অন আ ট্রেন’ (১৯৫০)-এর মতো ছবি। অর্থাৎ ‘রেবেকা’, ‘রোপ’, ‘ফরেন করেসপনডেন্ট,’ ‘লাইফবোট’, ‘স্পেলবাইন্ড’, ‘নটোরিয়াস’ প্রভৃতি অসাধারণ ছবিগুলো ততদিনে তৈরি করে ফেলেছেন আলফ্রেড হিচকক।
কিন্ত দুই মহারথীর কাজের মধ্যে কালীক দূরত্ব যতই থাকুক, দু’জনের কর্মজীবন খুব ক্ষীণ হলেও যে এক অদৃশ্য রেখায় সংযুক্ত ছিল, সেকথা মনে হতে পারে দু’জনেই ছায়াছবির জগতে পদার্পণের ঠিক পূর্ববর্তী অবস্থাটা নজর করলে।
নৈশ বিদ্যালয়ের পড়াশোনার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ষোলো বছর বয়সে হিচকক একখানা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিলেন হেনলে টেলিগ্রাফ অ্যন্ড কেবল কোম্পানিতে। সেইসঙ্গে পড়াশোনা চালাতেন কোনোক্রমে। সন্ধ্যার ক্লাসে যে বিষয়গুলো তিনি পড়তেন, তার একটা ছিল শিল্পের ইতিহাস। কিছুদিনের মধ্যেই চাকরিতে পদোন্নতি হয় হিচককের। তাঁকে পাঠানো হয় বিজ্ঞাপন বিভাগে। সেখানে খবরের কাগজে বা পত্রিকায় কোম্পানির যে বিজ্ঞাপনগুলো প্রকাশিত হবে সেগুলোর গ্রাফিক ডিজাইন, লে-আউট প্রভৃতির দায়িত্ব তাঁর ওপর দেওয়া হয়েছিল। আর এই কাজ করতে করতেই হিচকক ছায়াছবির জগতে পদার্পন করেন।
হেনলে কোম্পানিতে হিচকক যে ধরনের কাজ করতেন, ডি জে কিমার-এ ঠিক সেইরকম কাজই করতে হত সত্যজিৎ রায়কে। সেইসঙ্গে সিগনেট প্রেসের জন্য যে কাজ তিনি করতেন, সেও কিন্তু আদতে চিত্রণ এবং ডিজাইন নির্মাণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বলা যেতে পারে, এইরকম কর্মজগৎ থেকে সিনেমার জগতে এসেছিলেন হিচকক এবং সত্যজিৎ রায়।
কিন্তু সত্যজিৎ রায় যখন ‘পথের পাঁচালী’-র শুটিং শুরু করছেন, তখন হিচকক ব্যস্ত ‘আই কনফেস’ ছবিটি নির্মাণে। অর্থাৎ সেই সময়ে, তখন পর্যন্ত নির্মিত হিচককের ছবিগুলোর বেশিরভাগ দেখা হয়ে গিয়েছে সত্যজিৎ রায়ের। এবং সত্যজিৎ জেনে গেছেন আলফ্রেড হিচকক কীভাবে ‘ছবির নামের সঙ্গে নিজের নাম জড়িয়ে পরিচালকের অধিনায়কত্বের ব্যাপারটা প্রচার করতে পেরেছিলেন।’
সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন— ‘ছবি যদি সাংগীতিক গুণে, অর্থাৎ ছন্দ, গতি, কনট্রাস্ট ইত্যাদি গুণে, বিশেষ সমৃদ্ধ হয়, তাহলে সে-গুণ বিষয়বস্তুর মামুলিত্ব ছাপিয়ে শিল্পের স্বরে উন্নীত হতে পারে।’
হিচককের বেশ কিছু ছবি যে এই গুণে সমৃদ্ধ, সেকথাও সত্যজিৎ স্বীকার করেছেন অকুণ্ঠভাবে। যে হিচকক সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় আরও বলেছিলেন— ‘অজস্র ছবির অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞান তাঁকে মুনশিয়ানার এমন স্তরে নিয়ে তুলেছিল, যে আজও তাঁর সেরা ছবিগুলো দেখতে বসে সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যায় তা বোঝা যায় না।’ সেই হিচককের ছবি এবং কর্মপদ্ধতি যদি সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে বা কাজে কোনোরকম প্রভাব বিস্তার করে থাকে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
সাধারণ বিচারে হিচককের ছবির সঙ্গে সত্যজিতের ছবিগুলোর একেবারেই কোনো মিল নেই। প্রথমোক্ত ব্যক্তির ছবি তৈরির প্রধান এবং হয়তো একমাত্র, লক্ষ্য ছিল ‘সাসপেন্সের সাহায্যে চিত্তবিনোদন’। রহস্য কাহিনি নিয়ে ছবি সত্যজিৎ রায় করেছেন অন্তত তিনটে। ‘চিড়িয়াখানা’, ‘সোনার কেল্লা’ এবং ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। সেখানে সাসপেন্স যথেষ্টই এবং তা আছে অনেকটাই হিচককীয় শৈলীতে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ‘চিড়িয়াখানা’য় গ্রিন হাউসে ঝোলানো টবে ব্ল্যাকমেলের টাকা রেখে যাওয়া এবং সেই টাকা সরানোর আগেই খুনের তদন্তে ব্যোমকেশ-সহ পুলিশের সেখানে আগমনের দৃশ্যটি; কিংবা ব্যোমকেশ বক্সী যখন ভুজঙ্গ ডাক্তারের গোপন ঘাঁটিতে অনুসন্ধান চালাচ্ছে, তখন সেই বাড়ির প্রতিবেশি মেয়েটির হাত-পা-মুখের বাঁধন খুলে ফেলা এবং তার মায়ের ডাকে সাড়া না দেওয়া দৃশ্যটির কথাও।
‘সোনার কেল্পা’ ছবিতে এই ধরনের সাসপেন্স দেখা যায় ডক্টর হাজরাকে পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়ার পর মুকুলের অভিব্যক্তির দৃশ্যে এবং জটায়ুর ঝোলা থেকে মন্দার বোসের ভোজালি চুরির ঘটনার দৃশ্যে। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে মগনলালের ডেরার ভেতরের প্রতিটি দৃশ্যেই চরম সাসপেন্স লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সত্যজিতের এই তিনটে ছবিকে যদি নিছক রহস্য কাহিনির চলচ্চিত্রায়ণ মনে করা হয়, অথবা ধরে নেওয়া হয় পরিচালক শুধু সাসপেন্সের সাহায্যেই দর্শকদের চমৎকৃত করতে চেয়েছেন, তাহলে কিন্ত চিত্রনির্মাতার প্রতি ঘোর অবিচার করা হবে। শরদিন্দু যেমন বলেছিলেন, ব্যোমকেশের কাহিনি গোয়েন্দা কাহিনি হিসেবে না পড়ে পাঠক সামাজিক উপন্যাস হিসেবেও পড়তে পারেন; এক্ষেত্রেও তেমন বলা যেতে পারে। তিনটে ছবিতে রহস্য, অপরাধ, গোয়েন্দা ইত্যাদি উপাদান থাকলেও এগুলোকে সামাজিক ছায়াছবি হিসেবে দেখতেও অসুবিধে হয় না।
হিচককের ছবিগুলোর চরিত্র সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন— ‘দৈনন্দিন বাস্তব জীবনে দেখা যায় এমন চরিত্রদের নিয়ে হিচকককে কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র সাসপেন্স সঞ্চারের উপযুক্ত মেলোড্রামার বাইরে এই চরিত্রগুলির কোনও অস্তিত্ব নেই। এই বিষয়টিকে সিরিয়াস আর্ট হয়তো বলা যাবে না, কিন্তু এভাবে সাসপেন্স রচনা করতে যে বিশেষ মুনশিয়ানার প্রয়োজন, সে-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।’
হিচককের ছবির ‘জঁর’-এর সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের নির্মাণ করা ছায়াছবির গোত্র সম্পূর্ণ আলাদা। একই কথা বলা যায় আলফ্রেড হিচকক এবং ফরাসি পরিচালক ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো’র ছবি প্রসঙ্গে। ১৯৬৪ সাল নাগাদ ত্রুফো’কে একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিতে সম্মত হয়েছিলেন হিচকক। একাধিক বৈঠকে প্রায় পঞ্চাশ ঘন্টা বা তার কিছু বেশি সময় কথা বলেছিলেন দুই দিকপাল পরিচালক। সেই সাক্ষাৎকারের লিখিত রূপ প্রকাশিত হয় ‘হিচকক’ নামের গ্রন্থে। ১৯৬৭ সালে বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হলে তার বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন আর এক জগদবিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক— সত্যজিৎ রায়। সেই আলোচনায় শ্রীরায় বলেছিলেন, ‘যে ত্রুফো হিচককের ঘরানার ছবিকে বর্জন করে অন্য ধরণের ছবি করতে শুরু করেছেন, তাকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়ে হিচকক কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন, সে বিষয়ে পাঠকের কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক।’ ওই একই আলোচনায় সত্যজিৎ মন্তব্য করেন— ‘ত্রুফো হিচককের ঘরানার পরিচালক তো না-ই। বরং বলা যায়, তার কাজের ধরনের সঙ্গে জঁ রেনোয়াঁর কাজের অনেক সাদৃশ্য আছে।’
একই কথা কিন্ত সত্যজিতের কাজ সম্পর্কেও বলা যেতে পারে। অথচ ফ্রাঁসো ত্রুফো হিচককের অন্ধ ভক্ত। আশ্চর্যের বিষয় হল, এই কথাও বলা যায় সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে। ধীরেশ ঘোষ তাঁর চলচ্চিত্র সম্পাদনার কলাকৌশল বইতে লিখেছেন— ‘…প্রতিটি চরিত্র তার অ্যাকশন ও রি-অ্যাকশন এবং মোটিফ যদি আইডেন্টিফাই করতে দর্শকের কনফিউশন হয়ে যায় তাহলে সাসপেন্সের দৃশ্য দানা বাঁধতে পারে না, এই ব্যাপারে দুই গ্রেট মাস্টারের (হিচকক ও সত্যজিৎ রায়) মধ্যে একটা মিল দেখা যায়।’ শুধু তাই নয়, দুই প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র নির্দেশকের সৃষ্টি একটু নজর করলেই বোঝা যায় হিচককের ছবির বিভিন্ন বিষয় বা দৃশ্য কীভাবে প্রভাবিত করেছে সত্যজিতের ছবিকে।
‘ফরেন করেসপনডেন্ট’ (১৯৪০) ছবির প্রধান পুরুষ-চরিত্র জনি জোন্স-এর ভূমিকায় জোয়েল ম্যাকক্রি-কে প্রথমে দেখা গেছিল খবরের কাগজের অফিসে কর্মহীন সময় কাটানোর জন্য কাঁচি দিয়ে কাগজ কেটে নকশা বানাতে। ঠিক এইভাবে কাগজ কাটতে দেখা গেছে ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে হাল্লার রাজাকে এবং ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির একটি দৃশ্যে উত্তমকুমারকে।
আলফ্রেড হিচককের একটা বিশেষত্ব ছিল, ছবির বিশেষ মুহূর্তে চরিত্রদের বলা সংলাপ দর্শকদের শুনতে না দিয়ে মূলত তাদের অভিব্যক্তির ব্যবহারে দর্শককে বিষয়টি বুঝিয়ে দেওয়া এবং সেই সঙ্গে যন্ত্রসংগীতের ব্যবহারে দর্শককে আরও বেশি করে দৃশ্যটির প্রতি আকৃষ্ট রাখা। এইরকম দৃশ্য সবচেয়ে সফলভাবে হিচকক দেখিয়েছিলেন ‘দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ’ ছবির পরবর্তী সংস্করণে, অ্যালবার্ট হলে জেমস স্টুয়ার্ট এবং ডরিস ডে-র দেখা হওয়ার দৃশ্যে। অবশ্য হিচককের ছবিতে এমন সিকোয়েন্স সেটাই প্রথম নয়। এই ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৬ সালে। তার একবছর আগেই ‘পথের পাঁচালী’ প্রদর্শিত হয়েছে কলকাতার বিভিন্ন সিনেমা হাউজে। সেই ছবিতে ঠিক একই পদ্ধতিতে সত্যজিৎ দেখালেন হরিহরের বাড়ি ফিরে এসে দুর্গার মৃত্যুসংবাদ পাওয়া।
‘স্ট্রেঞ্জার্স অন আ ট্রেন’ (১৯৫১) ছবির একটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছিল ফার্লে গ্র্যাঞ্জার এক রাতে রবার্ট ওয়াকারের বাড়িতে এলে বাড়ির পোষা কুকুরটি এসে হাত চাটবে অনাহুত অতিথির। কুকুরটা প্রশিক্ষিত হয়ে থাকলেও তাকে ক্যামেরার সামনে গ্র্যাঞ্জারের হাত চাটানোর জন্য শেষ পর্যন্ত হাতে চকোলেট-জাতীয় কিছু মাখাতে হয়েছিল। ঠিক এই ধরনের সমস্যা হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে। গ্রামে মিষ্টি বিক্রি করতে আসা চিনিবাস ময়রার পিছু নেওয়া দুর্গা আর অপুর পেছনে কুকুরকে দৌঁড় করাতে।
কুকুরের মালিক পরিচালককে বলেছিল নাম ধরে ডাকলেই কুকুর চলে আসবে। সেদিন আসেনি। পরপর এগারোবার সে সাড়া দেয়নি মালিকের ডাকে। পরে দুর্গার পেছন দিকে মুঠো করে রাখা হাতের ভেতর সন্দেশ রেখে দেওয়া হয়েছিল। সেই লোভে কুকুর শটের পর শট অপু-দুর্গার পিছু পিছু হেঁটে চলেছিল।
‘সাইকো’ (১৯৬০) ছবিতে শাওয়ারের নীচে হত্যার বিখ্যাত দৃশ্যটিতে একটি বিশেষ মুহূর্ত পরে জুড়ে দিয়েছিলেন হিচকক। সেখানে দেখানো হয়, যেন মেয়েটার পেটে এসে ছুরিটি বিদ্ধ হচ্ছে। আর একটি শট এমনভাবে দেখানো হয়, যাতে মনে হবে আততায়ীর ছুরি যেন নেমে আসছে ক্যামেরার ওপর। সিনেমার পর্দা ছিঁড়ে যেন বেরিয়ে আসবে ছুরির ফলা। দুটি দৃশ্যেই পেটের ওপর থেকে বা ক্যামেরার লেন্সের ওপর থেকে হাতে ধরা ছুরি সবেগে ওপরে ওঠানোর ছবি তুলে, সেগুলো উলটো করে গতি বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল। সিনেমার ভাষায় এর নাম ‘ফাস্ট মোশন রিভার্স শট’।
সত্যজিৎ রায় এই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে, মাগনলাল মেঘরাজের বাড়িতে নাইফ থ্রোইং-এর সিকোয়েন্সে। সেখানে বোর্ডে গেঁথে রাখা ছুরি খুব সরু অথচ শক্ত তার দিয়ে বেঁধে টেনে খুলে নেওয়া হয়েছিল। যাতে রিভার্স শটে দেখে মনে হয় দূর থেকে নিক্ষিপ্ত ছুরি বোর্ডে বিদ্ধ হচ্ছে।
ভিক্টর স্যাভিল এবং মাইকেল ব্যালকনের প্রোডাকশনে প্রথম জীবনে কাজ শুরু করেছিলেন হিচকক। সেখানকার প্রধান পরিচালক তখন গ্রাহাম কাটনস। নতুন কাজে যোগ দেওয়া আলফ্রেড হিচকক তখন অতি উৎসাহের বশে চিত্রনাট্য রচনা থেকে শুরু করে, শিল্প নির্দেশনা, পোশাকের ডিজাইন তৈরি, প্রোডাকশন ম্যানেজারি— সবই করতে শুরু করে দিয়েছেন। তা ছাড়া তাঁর নির্ধারিত সহকারী পরিচালকের কাজ তো ছিল। এতে কোম্পানি খুশি হলেও ব্যাপারটা গ্রাহাম কাটসের পছন্দ হয়নি। হিচকককে নানাভাবে অপদস্ত করার সুযোগ খুঁজতেন তিনি। তা ছাড়া ব্যালকনের কাছে কয়েকবার নালিশও করেন। যদিও তাতে কোনো ফল হয়নি। কাটসের ছিল নারী এবং সুরায় তুমুল আসক্তি। শেষ পর্যন্ত এই দুই কারণেই তাঁর পরিচালক-জীবন শেষ হয়ে যায়। প্রায় বছর দশেক পর, হিচকক যখন সিনেমা জগতে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নাম, তখন কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে হিচককের কাছে লোক পাঠিয়ে উমেদারি করেছিলেন গ্রাহাম কাটস। সেই সময়ে ‘দ্য থার্টিনাইন স্টেপস’-এর শুটিং চলছিল। হিচকক বিশেষভাবে লজ্জিত বোধ করলেও কাটস’কে সামান্য কিছু কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
অনেকটা এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল ‘নায়ক’ চলচ্চিত্রের অভিনেতা অরিন্দমের জীবনে। জীবনের প্রথম শুটিং-এর দিন বিস্তর মুখঝামটা এবং অপমান সহ্য করতে হয়েছিল তৎকালীন বিখ্যাত চরিত্রাভিনেতা এবং তারকা মুকুন্দ লাহিড়ীর কাছ থেকে। স্টুডিও ভর্তি লোকের সামনে এই সহ-অভিনেতা অরিন্দমকে কটুকথা শুনিয়েছিলেন বিনা কারণে। অনেক বছর পরে, অরিন্দম যখন ম্যাটিনি আইডল নায়ক হিসেবে বিখ্যাত, এক রাত্রে তার বাড়িতে হাজির হন মুকুন্দবাবু। তখন তার হাতে মদ খাওয়ার পয়সা পর্যন্ত নেই। অরিন্দমের কাছে তিনি দরবার করতে এসেছিলেন যাতে তার সুপারিশে সামান্য কিছু কাজ পাওয়া যায়। সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি ‘নায়ক’-এর প্রধান চরিত্র অরিন্দম। সে পরিচালক নয়। অভিনেতা। কিন্তু তার সঙ্গে মুকুন্দ লাহিড়ীর সম্পর্ক আর হিচককের সঙ্গে গ্রাহাম কাটসের সম্পর্ক যে এক সুরে বাঁধা, সেকথা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
চিত্রনাট্য রচনা হওয়ার পর বিভিন্ন সিকোয়েন্সের দৃশ্যগুলো আলাদা শট বা ফ্রেম-এ ভেঙ্গে সেগুলোর স্কেচ বানিয়ে নিতেন হিচকক। এভাবে ফ্রেমগুলো তৈরি থাকায় শুটিং-এর সময়ে ভুলভ্রান্তির সুযোগ থাকত না। এই স্কেচগুলোকে বলা হত ‘স্টোরি বোর্ড’। তবে পরে অনেক সময়ে রদবদল ঘটানো হত পরিচালকের নির্দেশে। ঠিক একইরকম অভ্যাস রপ্ত করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তিনি অবশ্য আলাদা করে স্কেচ আঁকতেন না হিচককের মতো। খেরো বাঁধানো যে খাতায় তিনি চিত্রনাট্য লিখতেন, তারই একপাশে নিজের হাতেই ফ্রেমগুলো কেমন হবে, তার স্কেচ এঁকে রেখে দিতেন।
‘বাক্স বদল’ ছবির চিত্রনাট্য এবং সংগীত রচনা করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। ছবির একটা দৃশ্যে এক ডাক্তার তার গোঁফ কামিয়ে ফেলা মুখ এক পুরোনো রুগির দৃষ্টির আড়ালে রাখতে চেম্বারের আলো নিভিয়ে টেবিলে রাখা টেবিল-ল্যাম্পটির ফোকাস ঘুরিয়ে রেখেছিলেন রুগির চোখের দিকে। ডাক্তারের নিজের মুখটি ছিল অন্ধকারে। ডাক্তারবাবুর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। ঠিক এই ধরনের একটা দৃশ্য দেখা গেছিল ১৯৩৪ সালে নির্মিত ‘দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ’ ছবিতে। ডেন্টিস্টের চেয়ারে ডাক্তারকে অজ্ঞান করে শুইয়ে তার দাঁত দেখার ভান করেছিলেন, ডাক্তারের সাদা কোট গায়ে চাপানো ছবির প্রধান পুরুষ-চরিত্র। অপেক্ষা করছিলেন শত্রুপক্ষের কারো আসার জন্য। ডেন্টিস্টের চেয়ারে ফিট করা জোরালো আলোয় মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিলেন দরজার দিকে, যাতে বাইরে থেকে আসা লোকটি চোখে আলো পড়ে তাকে ভালো করে দেখতে না পায়।
হিচকক যেমন সালভাদর দালি-কে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে ‘স্পেলবাউন্ড’ ছবির স্বপ্নদৃশ্যের অবতারণা করেছিলেন, তেমনি সত্যজিৎ দেখিয়েছিলেন ‘নায়ক’ ছবিতে অরিন্দমের স্বপ্ন। সালভাদর দালির মতো কারো সহায়তা পাওয়ার সুয়োগ বা সামর্থ্য সত্যজিতের ছিল না। তাঁকে তাই ভরসা করতে হয়েছিল নিজের সৃষ্টিশীল মগজাস্ত্রর ওপর। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সত্যজিৎ রাযও কিন্তু চূড়ান্ত সফল হয়েছিলেন দালির মতো সুররিয়ালিস্টিক স্বপ্নদৃশ্যটি রচনায়।
‘স্পেলবাউন্ড’ ছবির শুটিং-এর সময়ে ইনগ্রিড বার্গম্যান কোনো বিশেষ অভিব্যক্তি মুখে ফুটিয়ে তুলতে না পারায় হিচকক তাঁকে বলেছিলেন, ‘ফেক ইট’। অর্থাৎ নকল করো। এটা হিচককের বিখ্যাত উক্তিগুলোর একটা। কেউ যদি শ্যাম বেনেগালের সত্যজিৎ রায়ের ওপর করা তথ্যচিত্র ‘দ্য আর্ট অব ফিল্ম’ দেখেন, তাহলে গোড়াতেই দেখবেন ‘ঘরে বাইরে’ ছবির শুটিং-এর সময়কার কিছু দৃশ্য। সেখানে সত্যজিৎ রায়কে দেখা যায় মিস গিল্ডি-রুপী জেনিফার কাপুরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘জেনিফার, টেক ইয়োর পজিশন অ্যাট দ্য পিয়ানো, অ্যান্ড ফেক।’ সম্ভবত পিয়ানো বাজাতে জানতেন না জেনিফার, তাই এমন নির্দেশ।
সত্যজিৎ রায় যে হিচককের ছবির বড়ো অনুরাগী ছিলেন, সেকথা নিজের বিভিন্ন লেখায় যেমন তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, তেমন বুঝিয়েছেন কাজেও। পুত্র সন্দীপ রায় যখন সত্যজিতের লেখা গল্পগুলো নিয়ে হিন্দিতে টিভি সিরিয়াল করতে মনস্থ করলেন, তখন হিচককীয় স্টাইলে সেই সিরিজটার নাম রাখা হয়েছিল ‘সত্যজিৎ রে প্রেজেন্টস’। সত্যজিৎ-জায়া বিজয়া রায়ের স্মৃতিচারণ ‘আমাদের কথা’-য় উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁদের ‘সাইকো’ দেখে মুগ্ধ হওয়ার ঘটনার।
নিজের ছবিতে জনতার দৃশ্যে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হাজির হওয়া বা ক্যামিও রোলে আবির্ভূত হওয়া একটা নিয়মে পরিণত করেছিলেন আলফ্রেড হিচকক। ঠিক এমন অভ্যাস সত্যজিতের ছিল না। তবে কয়েকটা ছবির দর্শক তাঁর কণ্ঠস্বর শুনেছেন বিভিন্নভাবে। ‘প্রতিদ্বন্ধী’ ছবির না-দেখা রমেশদার কথাগুলো পরিচালকের নিজের বলা বলে শোনা যায়। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এ ভূতের রাজার গানটাও তিনি গেয়েছিলেন। তবে সেটা শোনানো হয়েছিল রেকর্ড-প্লেয়ারের গতি বাড়িয়ে। তা ছাড়া ‘আগন্তুক’ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র মনোমোহনের গেয়ে ওঠা শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামের পদ, জয়দেবের একটা লাইন, কিংবা দু-এক কলি রবীন্দ্রসংগীতে, সত্যজিতের কন্ঠস্বরই শোনা গেছে। এগুলোও কিন্তু এক ধরনের ‘ক্যামিও’।
হিচকক বা সত্যজিতের ছবির বা শুটিং-এর প্রসঙ্গে এমন কতকগুলো ঘটনা নজরে আসতে পারে, যেগুলোর কথা আশ্চর্য হয়ে ভাবতে হয় যে, একই ঘটনা কীভাবে দুজনের জীবনেই ঘটতে পারে! যেমন, ‘জলসাঘর’ ছবির জন্য নিমতিতার চৌধুরীবাড়ি দেখে পছন্দ হওয়ার পর সত্যজিৎ রায় জানতে পারেন, এই বাড়িরই এক জমিদারের কথা ভেবে তারাশঙ্কর বিশ্বম্ভর রায়ের চরিত্রটি সৃষ্টি করেন।
‘শ্যাডো অব আ ডাউট’ ছবির ব্যাঙ্কের কর্মচারী চরিত্রের উপযুক্ত একটা বাড়ির জন্য উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা রোজায় যে বাড়িটা নির্বাচন করা হয়েছিল, পরে দেখা যায় সত্যিই এক ব্যাঙ্ক-কেরানি ওই বাড়িটির মালিক।
‘দ্য লজার’ তৈরি হওয়ার পর প্রযোজক সংস্থার কর্তা সি এম উলফের ছবিটি অপছন্দ হওয়ায় রীলগুলো ক্যানে বন্দি করে রেখে দেওয়া হয় প্রায় দু-বছর। আলফ্রেড হিচককের ছায়াছবি পরিচালনার শখ হয়তো সেখানেই মিটে যেত, ওই সংস্থার আর এক কর্তা মাইকেল ব্যালকন যদি না বুদ্ধি খাটিয়ে ছবিটি রিলিজের অন্য ব্যবস্থা করতেন। ঠিক এইরকম না হলেও প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটতে বসেছিল সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটির ক্ষেত্রে। টাকার অভাবে ছবির কাজ বন্ধ করে পরিচালককে বসে থাকতে হয়েছিল প্রায় বছরখানেক। বহু মেহনতের পর অর্থসংকট মিটলে যা হয়েছিল, তা এখন বাংলা ছায়াছবির গৌরবময় ইতিহাস।
সি এম উল্ফ অবশ্য হিচককের ‘দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ’ (১৯৩৪) ছবিটিও আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত যে পারেননি এবং এই ছবিটিও সফল হয়েছিল, সেকথা সকলেরই জানা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন হিচককের ‘লাইফবোট’ ছবিটি মুক্তি পায়। তখন ১৯৪৪ সাল। এই ছবিতে একটা জার্মান সাবমেরিনের ক্যাপ্টেনের চরিত্র ছিল। কাহিনির প্রয়োজনে লোকটিকে কর্মদক্ষ, কষ্টসহিষ্ণু, বুদ্ধিমান এবং ঠান্ডা মাথার মানুষ হিসেবে দেখানো হয়। তাতেই ঝড় ওঠে বিতর্কের। বেশ কিছু তথাকথিত দেশপ্রেমিকের পক্ষ থেকে ছবিটা বন্ধ করে দেওয়ার দাবিও তোলা হয়। তাদের বক্তব্য ছিল, জার্মানরা সকলেই নাৎসি এবং তাদের কোনো গুণ থাকতে পারে না।
ঠিক একইরকম সমস্যায় পড়তে হয়েছিল সত্যজিৎ রায়কে, ‘প্রতিবন্ধী’ ছবিটি মুক্তির পর। ছবির একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শেফালি। অর্থাৎ প্রথম বাঙালি ক্যাবারে ডান্সার হিসেবে বিখ্যাত ‘মিস শেফালি’। তাঁর চরিত্রটি ছিল একজন নার্সের। একটি দৃশ্যে তাঁকে নার্সের পোশাক ছেড়ে, ব্রেসিয়ার পরা অবস্থায় ঝুঁকে সিগারেট ধরাতে দেখানো হয়। ছবি রিলিজের পর নার্সদের ইউনিয়ন থেকে আপত্তি জানানো হয়, ওঁদের পেশাকে নাকি অপমান করা হয়েছে। যেন একজন নার্স এরকম করল বলে সকলেই করবে।
সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন— একজন পরিচালকের যখন ছবিতে বলার মতো গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য কিছু থাকে না, তখন তাঁকে কৌশল বা টেকনিকের ওপর নির্ভর করতে হয়। এর এক ধ্রুপদী উদাহরণ বলা যেতে পারে হিচকক। তাঁর বিখ্যাত ছবিগুলোর মূল আইডিয়া টেকনিকের মাধ্যমে এমনভাবে দর্শকের কাছে পেশ করা হয় যে, তার প্রশংসা না করে উপায় থাকে না।
সত্যজিতের ছবির ক্ষেত্র অন্যরকম। সেখানে অবশ্যই বলার মতো কিছু থাকত এবং সেটা তুলে ধরা হত চরম দক্ষতার সঙ্গে। গ্রামের জীবন ও প্রকৃতি সাধারণ মানুষের আটপৌরে জীবন, জীবনের নানা বাস্তব সমস্যা, কোনো সম্পর্কের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক সংকট, নিজের স্বাভাবিক পরিবেশের বাইরে মানুষের আচরণ ইত্যাদি পরিস্ফুট হত সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায়।
একজন চলচ্চিত্র-পরিচালক হিসেবে হিচকক যেমন মাইকেল ব্যালকন, ডেভিড সেলঝনিক, টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স, ওয়ার্নার ব্রাদার্স বা প্যারামাউন্টের মতো প্রযোজক পেয়েছেন, অ্যামা হিচকক, জন মাইকেল হেস, বেন হেক্ট, আর্নস্ট লেম্যান, স্যামুয়েল টেলর, জোসেফ স্টিফানো প্রমুখর মতো চিত্রনাট্যকার পেয়েছেন, পেয়েছেন এডিথ হেড-এর মতো ড্রেস-ডিজাইনার, পেগি রবার্টসন বা জোন হ্যারিসনের মতো সংগীত পরিচালক, তেমনি সত্যজিৎ রায়ের কপালে জোটেনি। কাহিনি নির্বাচন, চিত্রনাট্য রচনা, সংগীত আরোপ এবং সবথেকে বড় কথা, প্রযোজক খুঁজে পাওয়া— সবই তাঁকে নিজে করে নিতে হয়েছে বেশিরভাগ ছবিতে। হলিউডের সুবিধে যে সত্যজিতের ছিল না, সেকথা না বললেও চলে। স্ট্যান্ড ইন, স্টোরি কনফারেন্স, কন্টিনিউইটি দেখার লোক প্রভৃতি সুবিধা সত্যজিৎ কোনোদিন পাবেন বলে আশাও করেনি।
সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র পরিচালনার কাজে আসার উৎসাহের সিংহভাগ যে বহু বিদেশি ছায়াছবি দেখার ফলে পেয়েছিলেন, সে কথা অনেকেই জানেন। অতএব আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালকদের কাজ তাঁর কাজকে যদি প্রভাবিত করে থাকে, তাতে সত্যজিতের মহত্ত্বই প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে হীনমন্যতার কোনো জায়গা নেই। বরং ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো যেভাবে হিচককের সাক্ষাৎকার নিয়ে তাঁর মনের কথাগুলো জনসমক্ষে এনে অমর করে রাখলেন, তেমন সত্যজিতের ক্ষেত্রে করতে কেউ উদ্যোগী হলেন না, বা উদ্যোগী হয়ে থাকলেও কাজ সম্পূর্ণ হল না, সে কথা ভেবেই হীনমন্যতায় ভোগা উচিত বাঙালি চলচ্চিত্র রসিকদের।