ভাষা নীতি এবং একটি ‘২১’

ভাষা নীতি ও পরিকল্পনা একটি বিশ্বজনীন ব্যাপার। ভাষা সম্পর্কিত চিন্তা ও তার
সুষ্ঠু প্রয়োগ ভাষাকে শৃঙ্খলা দেয়। তাই এ-বিষয়ে নীতি ও পরিকল্পনা নির্ধারণ করা
হয়ে থাকে। এই নীতি ও পরিকল্পনা জাতিতে জাতিতে ভিন্ন হয়ে থাকে। তবু ভাষা
নিয়ে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রায় সব দেশেই বিবেচ্য। তা না হলে ভাষা-বিশৃঙ্খলা
অবশ্যম্ভাবী। সেটা আমাদের বাংলা ভাষায়ও দেখতে পাচ্ছি। বাংলা ভাষার ওপর
কালে কালে অত্যাচারের বুলডোজার চালানো হয়েছে। ফলে সংহত একটা
বানানরীতি যা সর্বসম্মত হতে পারতো, তা পর্যন্ত এখনও দূর অস্ত। কিন্তু এমনটা
তো হওয়ার কথা ছিল না। বাংলা ভাষায় এমন এমন সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছে,
যাঁদের চিন্তাকে গ্রহণ করলে ভাষার এই পঙ্কিলতা দেখতে হতো না।

সাধারণত ভাষা-পণ্ডিত ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতারা ভাষা-পরিকল্পনায় অংশ
নেন। তাঁরা কোনো সিদ্ধান্তে ঐক্যমতে পৌঁছান। তারপরই কেবল তা
সর্ব-সাধারণের কাছে গৃহীত হয়। ভাষার স্থিতি, পরিমার্জন, লালন-পালন ইত্যকার
বিষয় এখানে কাজ করে। ভাষা নীতি ও পরিকল্পনার সিদ্ধান্তগুলো ভাষার প্রাণশক্তি
সঞ্চার থেকে শুরু করে, সামষ্টিক জনগোষ্ঠী, এমনকি ব্যক্তির অধিকারের উপর
একটি বড় প্রভাব ফেলে। কিন্তু এ-বিষয়ে যদি কেবল বানানের কথাই ধরি, তা
ব্যাপক সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মনোপূত হয়নি বলেই আমাদের ধারণা।

উনিশ শতকে ইংরেজরা এদেশের পণ্ডিতদের ব্যবহার করে ভাষার ওপর ছুরি-কাঁচি
চালিয়েছিল। এরপর ক্রমাগত স্বাধীনতার পরেও ভাষার ওপর ছুরি থেকে
বুলডোজার সবই চালানো হয়েছে। এখানে বিরাট জনগোষ্ঠীকে অবজ্ঞা করা
হয়েছে। অবজ্ঞা করা হয়েছে শিশুদের মনস্তত্ত্ব। তাদের গ্রহণ করার
সক্ষমতা-অক্ষমতা বিবেচনা না করেই ভাষার বানান বারবার বদল করা হয়েছে।
এটা একটা জাতির মানসগত অস্থিতিশীলতারই পরিচয় দেয়। তাতে আবার
জনমানসের যোগ নেই। তাদের বিবেচনার ওপর কখনও কোনো জরিপ চালানো
হয়েছে বলেও মনে পড়ে না।

এখন কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন— দু একটা ব্যতিক্রম ছাড়া পৃথিবীর কোনো ভাষাই
উচ্চারণমাফিক লেখা হয় না। কিন্তু এটাও ঠিক—বারবার যথেচ্ছা বদলও করা হয়
না। ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর নানা দেশে ভাষায় নানা ধরনের সংশোধন
ঘটেছে। কিন্তু তারা বেশিরভাগই শেষপর্যন্ত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করেছে।
ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য পুরনো বানান রীতিতেও ফিরে গেছে। আবার
কোনো কোনো জাতি কম্পিউটার ও ইন্টারনেট জগতের সুবিধা নেয়ার জন্য
নিজেদের বর্ণমালাই বিসর্জন দিয়েছে। যেমন মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি।
আমরা আমাদের ঐতিহ্যও রক্ষা করতে চাই, একইসঙ্গে সুনির্দিষ্ট একটি ছাঁচও
তৈরি করতে চাই। আবার প্রাযুক্তিকভাবে বাংলা ভাষার আন্তর্জালিক বিবেচনা

এখনো শিশুজন্মের আতুরঘরে। আমাদের মহাপরিকল্পকরা মাঝেমধ্যে
শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে সভা করেন। তাতে কখনও হঠাৎ লাফিয়ে ওঠার
মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়, মুহূর্তেই তা আবার জল ঘোলা করে গভীর সমুদ্রে
তলিয়ে যায়।

পৃথিবীর বড় বড় সাহিত্যিক, যেমন, আমাদের রবীন্দ্রনাথ থেকে আমেরিকান মার্ক
টোয়েন পর্যন্ত বানান নিয়ে ভেবেছেন। তাঁরা তাঁদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও পেশ
করেছেন। যেমন ইংরেজি বানান উন্নতি নিয়ে মার্ক টোয়েন একটা পরিকল্পনা
দিয়েছিলেন। ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ জার্নালে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন :

“১ম বছরে অকেজো অক্ষর “c” কে “k” বা “s” দ্বারা প্রতিস্থাপন করার জন্য বাদ দেওয়া
হবে এবং একইভাবে “x” আর বর্ণমালার অংশ হবে না। একমাত্র কেস যেখানে “c” ধরে
রাখা হবে তা হবে “ch” গঠন, যা পরে মোকাবেলা করা হবে। ২য় বছর “w” বানান সংস্কার
করতে পারে, যাতে “what” এবং “one” একই ব্যঞ্জনা নিতে পারে। ৩য় বছর “y” কে বিলুপ্ত
করে “i” দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে পারে।

এভাবে তিনি বিশ বছরের পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন। বিষয়টা বেশ মজার আর
উচ্চারণমাফিক বানানের দিকেই নজর ফেরানো। কিন্তু তা হলেও এটি
সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়নি।

রবীন্দ্রনাথের ‘শব্দতত্ত্ব’ বইটি পড়লে রবীন্দ্রচিন্তার অসাধারণত্ব টের পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথ বারবার প্রাকৃত বাংলার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, অপভ্রংশের
নিয়মের কথা বলেছেন। বর্তমানে বাংলা ভাষার অনেক শব্দেরই ব্যুৎপত্তির ইতিহাস
নেই, পরিবর্তন-পদ্ধতির খবরও নেই। উনিশ শতকে হঠাৎ সাধুগদ্যের ঠমকে
চমকিত হয়েছিল বঙ্গের মানুষ। রবীন্দ্রনাথ একেই হয়তো ভাষা সম্পর্কে `Original
sin’ বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তা ‘সংস্কৃত সরোবর থেকে নালা কেটে নিয়ে’
আসা। তিনি বেশ সংযতভাবে কথাটা বলেছিলেন। আমরা বলি, খাল কেটে কুমির
আনা। যেখানে প্রাণ ছিল না, কিন্তু পাণ্ডিত্যের ঝলকানি ছিল। অন্যদিকে বাংলা
ব্যাকরণের প্রায় জাত-মারা হলো সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসরণে ভাষা-ব্যাকরণ তৈরি
করে। পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণে’র অপ্রয়োজনীয় রণ-ঝংঙ্কার বেজে চলেছে
আজও সমাস-কারকের ফাঁদে পড়ে। অথচ এগুলো বাংলা ভাষার জন্য খুব
প্রয়োজনীয় নয়।

শুধু প্রমিত বাংলা কেন প্রত্যেক আঞ্চলিক ভাষারই নিজস্ব ব্যাকরণ থাকে। সে-ভাষা
লিখিত হোক আর মৌখিক হোক। লিপিমালা থাকুক বা না-থাকুক একটি ভাষার
অন্তর্নিহিত ব্যাকরণ থাকা অবশ্যম্ভাবী। নোয়াখালির ভাষার সঙ্গে রংপুরের ভাষার
অনেক অমিল। এই অমিল ধ্বনি, শব্দ, এমনকি বাক্যগঠনেও। প্রাকৃত বাংলার
সাধারণ মানুষের ভাষার এই ব্যাকরণটা ঘষে ঘষে তার আসল আবরণটাই তুলে
ফেলা হয়েছে। এখন শুধু কঙ্কালটাই বাকি। তা নিয়েও টানাটানি বা টানাহেঁচড়ার
যেন শেষ নেই। এখন বাকিটা বিসর্জন দিলেই একশ্রেণির মানুষ খুশি হন।

তাই ভাষার যথোচিত পরিকল্পনা-গ্রহণ জরুরি বিষয়। সেই সঙ্গে জরুরি একে
সুনির্দিষ্ট ছাঁচে ঢেলে যুক্তিপূর্ণভাবে স্থাপন করা। ভাষার নীতি, প্রয়োজনীয়তা এবং
অনুশীলন সম্পর্কে সিদ্ধান্তসমূহ সামাজিক-রাষ্ট্রীয় প্রসঙ্গেও গুরুত্বপূর্ণ। কুপারের
ভাষায়, “ভাষা পরিকল্পনা বলতে বোঝায় তাদের ভাষা-কোডের অধিগ্রহণ, গঠন বা
কার্যকরী ক্ষেত্রে অন্যদের আচরণকে প্রভাবিত করার ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা।” এটি
আনুষ্ঠানিক, সরকারি অনুমোদনের মাধ্যমে গ্রহণ করা যেতে পারে বা
অনানুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক অনুশীলনে প্রতিফলিত হতে পারে।
ভাষা-পরিকল্পনা প্রায়শই যোগাযোগের সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা
হয়। তা সত্ত্বেও, অস্বাভাবিক ধারণা এবং খারাপভাবে গৃহীত নীতিগুলো দ্বারা
প্রভাবিত হতে পারে মানুষ। আবার ব্যক্তির উপরও তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে
পারে। অনেক সময় ভাষা-পরিকল্পনার অর্থ জনগোষ্ঠীর ওপর জোর করে চাপিয়ে
দেয়া এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও তা মানতে বাধ্য করা।

পাণ্ডিত্য আর ক্ষমতা জাহির করে ভাষা-শাসন করার পরিণাম কী হতে পারে, তা
ইতিহাসে অজানা নয়। কামাল আতাতুর্ক তুরস্কে যে-পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন
সেটি কালক্রমে ‘বজ্রআটুনি ফস্কা গেরো’তে পরিণত হয়েছিল। বাংলা ভাষার
পণ্ডিতদের অতিরিক্ত ভাষা-নিরীক্ষার ফল বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থা।
জনজীবনের ভাষারূপে সংস্কৃত ভাষার বিলুপ্তি ঘটেছিল অতিরিক্ত ভাষা-শাসনের
পরিণাম রূপে। কখনো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, কখনো জাতিগত আবার কখনো
অর্থনৈতিক শ্রেণিব্যবধান এসবই অনুঘটক হিসেবে ভাষাকে মৃত করে তুলেছে।
ভাবতে অবাক লাগে—যে-ভাষায় শক্তিশালী দার্শনিক জ্ঞান ও সাহিত্যগুণে ভরা
ধর্মীয় বেদশাস্ত্র নির্মিত হয়েছিল, তা কীভাবে কালে কালে অপরিচিত হয়ে উঠছিল!
অথচ সংস্কৃত ভাষা ছিল বেশ উচ্চারণমাফিক। এটা সংস্কৃতের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
পৃথিবীতে টিকে থাকা এরকম উচ্চারণমাফিক ভাষার মধ্যে রয়েছে সেমেটিক
ভাষাগোষ্ঠীর আরবি এবং ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর স্পেনিশ ভাষা।

সংস্কৃত ভাষার উচ্চারণ-বিশুদ্ধতা পালি ভাষাকে পর্যন্ত প্রভাবিত করেছিল। হয়তো
ধর্মীয় স্ক্রিপচার-এর বিশুদ্ধতার জন্যও তা প্রয়োজনীয় ছিল। বলা বাহুল্য—
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বাংলা ভাষায় উচ্চারণমাফিক বানান লিখতে চেয়েছিলেন।
কামাল আতাতুর্কের তিনি প্রশংসাও করেছিলেন এ-মর্মে যে, তিনি আর যাই হোক
উচ্চারণমাফিক বানান লেখার পক্ষে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন ব্যাপারটা। তবুও ১৯৩৪-৩৬ সালে প্রথম বানান সংস্কারের
প্রক্রিয়ায় ২০০ জন সচেতন শিক্ষিত পণ্ডিত বাঙালিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে সেই কলকাতার বানানের ওপর মাখন-মেয়োনেজ মাখিয়ে
পরিবেশন করা হলো মাত্র।

যে-কোনো শাসন যা মানুষকে পীড়ন করে তার অবলোপন ঘটতে বাধ্য। সাধারণ
জনতার তথাকথিত উন্নত ভাষার অধিকার নেই বলে যে-শ্রেণিবৈষম্য তৈরি হয়,

তা-ই যেন কাল হয় প্রাচীন ধ্রুপদী ভাষাগুলোর জন্য। নদীর স্রোত আর মানুষের
আবেগকে শৃঙ্খলে আটকে রাখা যায় না। নদীকে শাসন করা যায়– একথা মিথ্যে
নয়। কিন্তু সেটি নদীর স্রোতকে উপেক্ষা করে নয়। অর্থাৎ আপনি প্রাযুক্তিক
সাহায্য নিয়ে কিঞ্চিৎ গতিপথ পরিবর্তন যন্ত্রযুগে বসে করতে পারেন। তবে সেটাও
আপনাকে বিজ্ঞান মেনেই করতে হবে। কখনো জনমনস্তত্ত্ব মানাও জরুরি। নইলে
বালির বাঁধের মতো ধসে যাবে নদী শাসনের ফল।

কেবল সংস্কৃত ভাষা নয়, বিশ্বশ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি ও জ্ঞানের অধিকার নিয়ে যারা দোর্দণ্ড
প্রতাপে পৃথিবী শাসন করেছে, সেই সেই গ্রিক আর রোমানদের গ্রিক-ল্যাটিন
ভাষাও কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে। গ্রিক-ল্যাটিন দু ভাষা নিয়ে দ্বন্দ্ব রোমান
সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পরও বহুদিন ধরে চলেছে। কোনটি জ্ঞানের ভাষারূপে গৃহীত
হবে, কোনটি প্রশাসনের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হবে, সেসব নিয়েও দ্বিধা-বিচলিত
ছিল তখনকার পণ্ডিতবর্গ। আবার মানুষ বেড়ে গেছে কিংবা নতুন নতুন প্রশাসনিক
কেন্দ্র তৈরি হয়েছে, জনগোষ্ঠীতে নতুন নতুন ভাষা সৃষ্টি হয়েছে। তখন আবার
নতুনভাবে চিন্তা করতে হয়েছে।

প্রত্যেকটা ভাষাই পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তন ও মানুষের রুচির হাত ধরে নতুন
নতুন শব্দ তৈরি হয়েছে। সেসব নতুন শব্দ ক্লাসিক্যাল যুগ থেকে নিও-ক্লাসিক্যাল
যুগ পর্যন্ত নানা বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে। গ্রহণ ও বর্জনের একটা বাক্-বিতণ্ডার
খেলায় মত্ত হয়েছে প্রত্যেক ভাষার পণ্ডিত, সাহিত্যিক, এমনকি বাস্তবসম্মতভাবে
অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গ। সে-কারণে রোমান ক্লাসিক যুগে বসেও হোরেস,
কুইন্টিলিয়ান প্রমুখ কবি ও সমালোচকগণ নতুনকে আহ্বান জানাতে পিছিয়ে
থাকেননি। বসন্তে সৌন্দর্যদানকারী নতুন পত্রপল্লবের সঙ্গে তাঁরা ভাষার শব্দকে
তুলনা করেছেন। অর্থাৎ পুরনো পাতা ঝরে গিয়েই কেবল নতুন পাতা গজিয়ে ওঠে।
তাতে বৃক্ষের মান কমে না। বরং নতুন পত্রপল্লব আর পুষ্পসজ্জিত হয়ে নিজের
মহিমাই ঘোষণা করে। এখানে বৃক্ষটাই সেই ক্লাসিক উপাদান, যা দাঁড়িয়ে থাকে
বছরান্তে, একইভাবে। হয়তো সেটাও পুষ্ট হয়, কলেবরে বর্ধিত হয়, তবে তা অতি
ধীর প্রক্রিয়ায়। প্রতিদিনের চোখ ধাঁধানো বিষয় তা নয়, এমনকি নয় বসন্তের
নবপুষ্পের মতো নিত্যনতুন। কিন্তু বসন্তের পত্র আর পুষ্পকে তো বৃক্ষের মতো
অনড় হলে চলে না। সেটা মহাকবি ভার্জিল, দান্তে, মিল্টন সবাই বুঝেছিলেন।

রোমান্টিকতার কালে ভাষা নিয়ে বিশেষ শুচিবাই থাকলো না। তখন ভাষায় হুড়মুড়
করে মানবিক আবেগ ঝরে পড়া শুরু করলো। ভাষাও তার আপন ক্রোড়ে
নবউত্থিত ভাষার বিচিত্র নতুন নতুন উপাদানে সৌন্দর্যে অভিষিক্ত হওয়া শুরু
করলো। কেননা আধুনিকতা আসার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্বাধীনতা আর প্রগলভ
প্রকাশের ক্ষমতা ক্রমবর্ধিত হচ্ছিল। বিজ্ঞানের আবিষ্কার ভাষাবৈজ্ঞানিক জগতেও
প্রভাব ফেলছিল। আর তা প্রবল প্রতিপত্তি নিয়ে সেই স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিচ্ছিল।

পুরনো মানচিত্র ভেঙেই নতুন নতুন দেশ, নতুন নতুন জাতি তৈরি হয়। সেই নতুন
জাতির জন্য স্বদেশ উপযোগী ভাষা-স্বীকৃতিরও প্রয়োজন হয়। শুধু একভাষা নয়,
কখনও বহুভাষারও প্রয়োজন পড়ে। বহুজাতির ভাষা-স্বীকৃতি আর বহুসংস্কৃতি
রক্ষাও আধুনিক রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য কাঠামো। অধুনান্তিক কালে বহুবিধ
জ্ঞানশাস্ত্র চর্চায় বহুসংস্কৃতি, বহুভাষা ইত্যাদি বহুতল চিন্তাকাঠামো কতটা
উপযোগী, তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি।

ভাষা নদীর স্রোতের মতো শব্দের খড়কুটো আত্মীকৃত করে সমুদ্রের দিকে ধাবিত
হয়। এখন এই অডিও-ভিজুয়াল যুগে মানুষের যাতায়াত কেবল জলপথে নয়,
সড়ক পথ ছাড়িয়ে আকাশপথেও। ফলে ভাষাকেও আকাশপথে গমণ করতে
হচ্ছে। আন্তর্জালিক, আকাশ-সংস্কৃতির চর্চা তো সেটাই বলে। এখানে ভূগোলের
সীমায় অনাবদ্ধ মানুষ যে-কোনো সংস্কৃতি, যে-কোনো ভাষার শিল্পের
দর্শক-শ্রোতা-ভোক্তা। রাষ্ট্রীয় নীতি সেটা শাসন করতে পারে। কিন্তু আপাদমস্তক
বেঁধে রাখতে পারে না।

কিন্তু ভাষা-রাজনীতির খপ্পরে পড়লে মুহূর্তেই কোনো জাতি দিক হারিয়ে ফেলতে
পারে। তাদের জীবনে নেমে আসতে পারে ভয়াবহ দুর্বিপাক। দিনের পর দিন ভাষা
ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব নিরসন হয় না। অধিবাসীরা নিজ ভূখণ্ডেই হয়ে যান অনাবাসী।
এই আত্মদ্বন্দ্বে ভুক্তভোগী আজ বহু জাতি। কানাডা এতো ধনী রাষ্ট্র হয়েও কুইবেক
অঙ্গরাজ্য আলাদা হয়ে যেতে চায় শুধু ভাষার কারণে। তারা ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা
মানতে নারাজ। ফরাসিকে নবরূপকল্পিত রাষ্ট্রের ভাষা করতে চায়। এরকম
উদাহরণ খুঁজলে প্রত্যেক মহাদেশেই পাওয়া যাবে। অথচ এইসব ভাষা সবসময়
তাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যসূত্রে প্রাপ্ত ভাষাও নয়, বরং তা কখনও উপনিবেশের
ভাষা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ইংরেজি যেমন একসময়ের উপনিবেশের ভাষা।
কিন্তু ভাষাকে সর্বসম্মত স্বীকৃত দানের পর সেটা আর অন্যের থাকে না। একান্ত
নিজেরই হয়ে ওঠে।

ভাষা নিয়ে সময়ে সময়ে অযাচিত বিতর্কের জন্ম হয়। এইতো কিছুদিন আগেও
ঢাকায় ‘কাওয়ালি’ গান নিয়ে ধুন্দুমার কাণ্ড হয়ে গেল। ভাষা নিয়ে এই অজ্ঞানপ্রসূত
মূর্খতার শেষ নেই। কেননা যুগে যুগে ভাষা হয়ে আছে ক্ষমতা-প্রদর্শনেরও প্রতীক।
নেপোয়রা সেখান থেকে দই মারতে চায়। যে-কোনো ভাষার শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত
নিয়ে ভাষা নামক বিশাল বারিধিতে অবগাহন করা যেতে পারে। কিন্তু
ভাষা-সাম্প্রদায়িকরা কখনও সেটা নিয়েই বচসায় লিপ্ত হয়। একশ্রেণির
সুবিধাবাদীরা সেখান থেকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে।

অন্যদিকে মানুষের মন রক্ষা করতে গেলে ভাষার জাত থাকে না। একথাও হয়তো
সর্বৈব সত্য নয়। কারণ ভাষা-অর্জন মানুষের সহজাত হতে পারে কিন্তু ভাষা-বাছাই
সহজাত নয়। যেমন আমরা যে প্রমিত বাংলায় কথা বলি তা জনগোষ্ঠীর
‘মাদারটোন’ না-ও হতে পারে। অর্থাৎ একটা ‘আদর্শ’ বা ‘প্রমিত’ ভাষা থাকা চাই।

কিন্তু মানুষের শেকড়গত সামাজিক-পারিবারিক যোগাযোগের জন্য আজও
আঞ্চলিক ভাষার বিকল্প নেই। দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে তা যা-ই থাকুক না কেন।
এখানে সাধারণ মানুষের আর্থরাজনীতি ও সমাজ-সাংস্কৃতিক কারণে আঞ্চলিক
ভাষারও অনেক গুরুত্ব রয়েছে। কথাটা আরও এজন্য বলা যে, আজ বাংলাদেশের
বহু মানুষ ইংরেজিতে কথা বলে, সন্তানকেও ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান করায়।
নিজেদের অভিজাত হওয়ার প্রসঙ্গটাও সেই ব্রিটিশ যুগের ফসিল হয়ে প্রত্নরূপে
বর্তমানেও আছে। কেউ কেউ তো এদেশের বাসিন্দা বলে নিজেকে হেয়, স্বয়ং
নিজের মাতৃভাষাকে ঘৃণাই করে। তারা বিদেশে সেটেল করে, পারলে
পিতা-পিতামহের জন্মকেও মুছে দিতে চায়। মধ্যবিত্ত সংস্কৃতসেবী সমাজ তাদের
টিকিটির সন্ধানও পায় না। কারণ ওরা স্বদেশেও বিদেশি। আবার কেউ দেশ ছেড়ে
বিদেশে গেলেও নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধারণ করার জন্য পাগলপাড়া। কাজেই
যে-কোনো বাস্তবতার নানামুখি বয়ান রয়েছে।

অন্যদিকে রাষ্ট্রভাষা গ্রহণের অর্থও সবসময় মাতৃভাষাকে সর্ববাদীসম্মত মূল্য দেয়া
নয়। ভাষা জটিলতা-আক্রান্ত নানা জাতির দিকে তাকালেই এটা স্পষ্ট হবে। ‘থিংস
ফল অ্যাপার্টে’র লেখক চিনুয়া আচিবিকে সেকারণেই নিজের মাতৃভাষায় ফেরৎ
আসতে হয়। ‘ডি কলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’ গ্রন্থ রচয়িতা নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গাকে
নিজ সংস্কৃতি ও অধিকারের কথা বলায় জেলে পাঠানো হয়। জেলবাসের পর তিনি
ইংরেজির আধিপত্য ছেড়ে নিজভাষা ‘গিকুইউ’তে সংগ্রাম ও লেখালেখি চালিয়ে
যান। এভাবেই একটা তুচ্ছ ভাষা মহামহিম স্থান দখল করে। বাংলা ভাষা নিয়ে নিত্য
নতুন লড়াই করা আমাদের প্রয়োজন। এই লড়াই পারিবারিক-সামাজিক-জাতীয়
জীবনে প্রয়োগ ছাড়া ভাষার সত্যিকার মূল্য কি? এটা অনিবার্য—শাসক শ্রেণি
সবসময়ই নিজেরটা চাপিয়ে দিতে চায়। এ-প্রসঙ্গে নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গার
ছোটবেলার স্কুলের দগদগে স্মৃতির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। যেখানে স্কুলের
বাচ্চাদের অহরহ বেত দিয়ে পিটানো হতো। তারা তাদের মাতৃভাষার যতো শব্দ
উচ্চারণ করতো ঠিক ততোমাত্রায় বেত্রাঘাত করা হতো।

ভাষা জীবনের মতোই একটি সংযত-অসংযত, আবেগ-নিরাবেগ, ব্যক্তি-সমষ্টি,
চৈতন্য-অচৈতন্যের ফসল। কাজেই মাতৃভাষাকে এড়িয়ে যাবার উপায় মানুষের
নেই। অন্তত শিশুকালে যারা যে ভাষা শিখেছে সেটাই তাদেরকে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে
সারাজীবন প্রচালিত করে। ‘সারোগেট বেবি’দের প্রসঙ্গ ভিন্ন। কিন্তু মাতৃ-পরিচিত
কোনো মানুষের পক্ষে মায়ের পরিচয় মুছে দেওয়া সম্ভব নয়। সেজন্য একটা ‘৫২’
কিংবা একটা ‘২১’ বাংলা সংস্কৃতির অনন্য স্মারক হয়ে থাকে। এই স্মারক বা নিদর্শন
ব্যতিরেকে একপা চলার অধিকার আমাদের নেই। পৃথিবীর সব জাতির এই নিদর্শন
থাকে না। আমাদের সে অধিকার আছে—এটাই আমাদের অহংকার। সে-অহংকার
যেন কেউ ধূলায় লুটিয়ে না দেয়, সে-ব্যাপারেও সদা অতন্দ্র থাকতে হবে এই
আমাদেরকেই।

লেখক: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ওয়েব-ঠিকানা : https://khorsed-alam.blogspot.com/

 

Scroll to Top