রায়বাঘিনীর ডেরা
১.
মন মরে যাবার পর নতুন অবয়ব পেল শরীর
রাতের বেলা পেশির অদ্ভুত আক্ষেপ জাগল
মন নাই তাই মনের আক্ষেপও নাই;
শরীরের সঙ্গী কেবল শরীর
শরীর এখন রাগ-অনুরাগ, হর্ষ-বিকার, সাধ, স্মৃতি ও আলাপশূন্য;
নিরাহ্লাদ, নির্বিষাদ শরীরকে ঘিরে রয়েছে এক নিরালাপ গজল
পঞ্চভূতের ক্রমাগত পীড়নেও
খরখরে এক কোবল্ড স্ট্রিটের উপর দিয়ে
ঘর্ঘর গড়িয়ে চলেছে শরীরের আশ্চর্য শকট
২.
নিজেকে খাইয়ে-দাইয়ে, নাইয়ে-শুইয়ে তুষ্ট করা ছাড়া
শরীরের কোনো দায় এখন আর নেই
সময়ে-অসময়ে মন আর ডাকছে না তাকে
আর সে-ও ডাকছে না মনকে;
—স্নায়ুতে ফুটছে না কোনো কাঁটা কিংবা বাসনার রক্তিম গোলাপ
-শরীর কেবল ডেকে চলেছে অন্য এক শরীরকে
৩.
শরীরকে অন্য শরীরের কাছে টেনে নেওয়াই কর্তব্য এখন
শরীরকে অন্য শরীরের ভেতরে নিয়ে যাবার উদ্যমই মুখ্য এখন
শরীরই হয়ে উঠেছে শরীরের সাধনোচিত ধাম
অন্ধকার টানেলের ভেতর দিয়ে আস্ত একটা মালগাড়িকে
টেনে নিয়ে যাওয়া এঞ্জিনের কর্তব্য যেমন
৪.
পিস্টনের প্রবল চাপে আস্ত একটা রেলগাড়িকে
চালান করে দিতে হয় অন্ধকারে অজানা টানেলের ভেতরে
শরীরের টানেলের ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে হয় অন্য শরীরকে
এরপর যথাসময়ে একে টেনে হিঁচড়ে
বের করে নিয়ে আসতে হয় বাইরে দেয়ালহীন খোলা মাঠে
—- পুরনো আসঙ্গ ও রতির মাকড়জাল ছিঁড়ে
প্রতিদিনের রোদে-হাওয়ায় একে ট্যানড করবার জন্য
পূর্বতন প্রেমের প্রতি উদাসীন আর বিমুখ করে তুলবার জন্য
এরপর খুঁটিয়ে দেখতে হয়
অন্য শরীরের কতটুকু মোম লেগে রয়েছে এখনো;
ক্ষণ-সান্নিধ্যের ঝাঁজ ও চুম্বক কতটুকু অবশিষ্ট আছে
৫.
নদীর খোড়লে, দ্যাখো,
কাঁকড়াকে খেয়ে তবে কাঁকড়ার ছেলে বের হয়!
৬.
শরীরকে আগের আদলে ফিরিয়ে আনার জন্য ধোয়ামোছা জরুরি
অভ্যেসের মরচে ও গাদ ঝরিয়ে ফেলাটা জরুরি
নতুন কিছু শুরু করবার আগে আসঙ্গের সব স্মৃতি, রেণু
রগড়ে-ঘষে তুলে ফেলাটা জরুরি
অনাস্বাদিত আর নতুন কোনো সুরা চেখে দেখা জরুরি
কেননা নব নব আরকে মাথা ডোবানোই উত্তম
৭.
গৃহপালিতের কুমন্ত্রণার বাইরে গেলেই তুমি পাবে
শরীরের বিকাশের গূঢ়-গাঢ় জাদু ও জগৎ!
বিয়োজনে মুক্তি । আর
বিমোচনে পরম পুলক
৮.
পত্রমোচী গাছই শুধু
নিস্বতার মর্মে ডুবে বসন্তের আনন্দ পেয়েছে
শিমুলের মর্ম থেকে তুলা ফেটে
শাল্মলিপ্রহর আজ অগণিত বীজে ভরে গেছে
৯.
এবং এখন অচেনা এক শহরতলির বাইরে
রৌদ্রনিরূপিত রাঙতাময় দুপুরে
একটি বিশীর্ণ নদী আর চিতাজ্বলা শ্মশানের ঠিক মাঝখানটায়
শুয়ে আছে এবড়ো-খেবড়ো এক কাঁকরবিছানো পথ
সেই পথের উপর দিয়ে
রায়বাঘিনীর ডেরার দিকে শরীর এখন
নিজেই নিজের রথকে টেনে নিয়ে চলেছে
পাশেই ঝোপের আড়ে মরে পড়ে আছে
বিপুলাকায় এক মন-কৃকলাস;
এখন তার পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার অপেক্ষা কেবল
১০.
এক প্রত্নপ্রেত চণ্ডাল দীর্ঘক্ষণ এই দৃশ্য একা বসে দেখেছে;
সে নিজেকে প্রশ্ন করছে: এসব ভূদৃশ্য দেখে
কোন মোক্ষ, কতটুকু স্বাদ তুমি পেলে?